Monday, October 17

নমিতা আচার্য্য


বন্যার তান্ডবে 




আমার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আমি, ব্লক বসানো রাস্তাটা সম্পূর্ণ শুকনো, আগের দিনের বৃষ্টির কোন চিহ্ন মাত্র নেই। হঠাৎ চোখে পড়লো রাস্তার দুপাশ দিয়ে জল আসছে। ভাবলাম কেউ বুঝি উঠোন ধোয়াচ্ছে, তাই জল। নিমিষেই রাস্তাটা ভরে উঠলো, চারিদিকে চিৎকার শুরু হলো, জল আসছে, জল আসছে। 

               দেখতে দেখতে ঘরের সামনের রাস্তাটা নদীতে পরিনত হলো, সে এক ভয়াবহ বন্যা, জলের স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে ছুটলো জঞ্জাল। মানুষের রাস্তা দিয়ে চলার ক্ষমতা নেই, একসাথে হাতে হাত ধরে পাঁচ-ছয় জন মানুষ পথ চলতে লাগলো। 

                সময় কতোটা মুল্যবান মানুষ জানলেও সেদিন হারে-হারে বুঝতে পেরেছে।ঘরের প্রয়োজনীয় নথিপত্র বের করার সময়টুকু পায়নি অনেকেই। নিজের প্রাণ বাঁচাতে যে যার মতো বেড়িয়ে এসেছে শূণ্য হাতে, জলের গতিবেগ এতোই বেশি ছিল মানুষ নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত। গোটা শিলচর শহর এক বিশাল নদীর আকার ধারণ করল। ঘরের দোরগোড়ায় বরাক নদীর জল। 

        মানুষ যে যার মতো করে ঠাঁই নিল, জল আর জল, বন্ধ হলো বিদ্যুৎ পরিষেবা। কোন ক্রমে ইনভার্টারে চার্জে এক-দু রাত কাটলে ও পরের দিন থেকে অঘোর অন্ধকারে মানুষ। মোবাইলে চার্জ পর্যন্ত দেওয়ার ক্ষমতা নেই, নেটওয়ার্ক বন্ধ। মোমবাতি বাজারে দুর্লভ। ধু-ধু করে বাড়লো জিনিসের দাম। 

         হেলিকপ্টারে খাদ্য বিতরণ হলে ও সবার ভাগ্যে তা জোটেনি, চারিদিকে পানীয় জলের হাহাকার। ডুবে গেল মোটর, রিজার্ভভার, বন্যার জল টুকু একমাত্র সম্বল। 

ভেসে চলে মানুষের মৃতদেহ। শ্মশান ঘাট ডুবে যাওয়ার মৃতদেহের মুখে আগুন জ্বালিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হলো জলের স্রোতে। 

জল ক্রমশঃ বেড়ে চলতে লাগলো, সঙ্গে মানুষের দুঃচিন্তা। কেউ কেউ কাঁদছে জিনিসের জন্য কেউ কাঁদছে মানুষের জন্য, করুন বিভীষিকা। চারিদিকে জল, রাতের অন্ধকারে সমস্ত এলাকা সমুদ্রের মতো মনে হলো, সাতদিন এভাবে কেটে আস্তে আস্তে কোন কোন জায়গা স্বাভাবিক হলে ও অনেক জায়গা জলমগ্ন। 

            বরাক নদীর জলে নষ্ট হলো কতো মানুষের সখের সাজানো সংসার, জিনিস- পত্র, সঙ্গে গৃহপালিত পশু-পাখী। মানুষ এখন স্তব্ধ প্রায়। কি করবে? কেমন করে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে? নদীর জলের সাথে, চোখের জল ভেসে চলেছে জানিনা কোথায়। নদীর জল যেমন গন্তব্যে পৌঁছে যায়, চোখের জল কি পৌঁছবে কোনো গন্তব্যে? 
                 

মুহাম্মদ ইয়াকুব ( বাংলাদেশ )


আত্মোপলব্ধি 


সাহিত্য মানব মস্তিষ্কে সৌন্দর্য, সুকুমার ও মহাত্ম্যপূর্ণ চৈতন্যের চাষ করে। পঙ্কিল মৎসর মানস এই অঙনে শ্রীহীন। এখানে কলমের ডগায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ঘটে যাওয়া, ঘটমান বা অনাগত ভবিতব্য বিষয়াদি দ্বিধাহীন প্রকাশ করার ব্যাপার সম্পৃক্ত থাকে। শক্তিমান কলমের ক্ষুরধার আঘাতে ইস্পাতকঠিন বিপ্রতীপ পাহাড় প্রকীর্ণ-বিদীর্ণ হয়। দুর্বল হাত প্রকম্পিত হয় অন্তর্ভেদী দর্পনের সামনে। সম্মুখ আলাপচারিতায় বিভক্তিরেখা প্রকট হয়ে দেখা দেয় প্রাজ্ঞ ও অপ্রতুল মননের মানুষের মাঝে।

সাহিত্যে আত্মতুষ্টি মারাত্মক এক ব্যাধি। বাংলার মানুষ আবেগের ঘোড়া দাবড়ায়, বিবেককে নিক্ষেপ করে নিশুতি আস্তাকুঁড়ে। অবচেতন মননে উচ্চাকাঙ্খী কিন্তু অশুচি স্বপ্নীল প্রাসাদ নির্মাণ করে যায়। পলাশী থেকে একাত্তর পর্যন্ত হযবরল সংগ্রামের ইতিহাসও দ্বিধাহীন চিত্তে তাই স্বীকার করে স্বীকারোক্তি প্রদান করে। হঠাৎ আত্মসম্মান বাঁচানোর প্রয়াসে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে পরক্ষণে আত্মবিক্রয়ের মিছিলে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। মূলস্রোতের সাথে সঙ্গতি রেখে আমাদের সাহিত্যকর্মীরা স্রোতের অনুকূলে নিজেদের কলমকে ভাসিয়ে দেয়। চলমান স্রোত অন্যায়-অসত্যের পক্ষে হলেও প্রতিকূলে চলার সৎ সাহস আমাদের নেই। তোষামুদে চেতনায় আঘাতপ্রাপ্ত হলেই একশ্রেণীর সাহিত্যকর্মী বলে বসেন, এটি রাজনীতির অঙন নয়। অথচ একজন প্রকৃত সাহিত্যকর্মী চলমান অন্যায়-অসঙ্গতির বিপক্ষে বলবেন, এটি খুবই স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত বিষয়। সাহিত্য রাজনৈতিক হাতিয়ার না হলেও রাজনীতি সচেতন। কিন্তু, আমাদের আত্মোপলব্ধির তথৈবচ সময় নেই। আমরা সাহিত্যমান নির্ণয়ে সচেষ্ট না হয়ে সাহিত্যকর্মীর লেখার বিষয়বস্তু এবং ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই। একটি ট্যাগ লাগানো গেলেই হলো ; তাঁর আর কোন মর্যাদা নাই, নাই কোন ভবিষ্যৎ! 

উজ্জ্বলা মল্লিক



গোপন তুমি 

প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে এমন একজন"তুমি"থাকে। যাকে কখনো ভুলে থাকা যায় না। 
সে "তুমি"টা হাসায়, কাঁদায়, আবার কখনো রোমান্টিকতায় ভাসায়।
সেই "তুমি" টা  একান্ত  শুধু নিজের থাকে।
তাকে কারো সাথে ভাগ করা যায় না।
সেই "তুমি"টার দেয়া আনন্দ সুখ-দুঃখ-কান্না-রোমান্টিকতা সব একা নিজেকেই ভোগ করতে হয়।

আর যদি কেউ বলে
তার জীবনে এমন কোন "তুমি" নেই,এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা।
আমি তাকে বলব ---
হৃদয়ের দ্বার খুলে, একবার অতীত আর বর্তমান ঘুরে আসুন।

একটা গোপন "তুমি"পেয়েই যাবেন।
সে হয়তো ছিল কৈশোরে, হয়তো যৌবনে নয়তোবা বর্তমানে আছে।
কিন্তু সে আছেই।

এই "তুমি"টা দূরে বহু দূরে থেকেও সবসময় আমাদের হৃদয় জুড়েই থাকে।
আমাদের হৃদয় জুড়ে তার বসবাস।
এ জীবনে এই "তুমি" টাকে ভুলে  থাকা অসম্ভব।
যেদিন আমাদের এই জীবন অবসান হবে-ঠিক সেই দিনই এই "তুমি"টারও অবসান ঘটবে।

এই "তুমি"টা আমাদের ছোট্ট জীবনে - বাড়ীর এক চিলতে বারান্দা হয়েই থাকুক।
যেখানে রোদ আসে, বৃষ্টি আসে, মিষ্টি  বাতাস বয়ে যায় সর্বক্ষণ।
সকাল আসে, রাত আসে,সন্ধ্যা আসে।
যেখানে একা দাঁড়িয়ে  ব্যস্ততম জীবনে প্রাণভরে শান্তির নিশ্বাস নেয়া যায়....
নিজের সাথে কথা বলা যায়।
হ্যাঁ এমনি এক চিলতে বারান্দা হয়ে আজীবন হৃদয়ে বেঁচে থাক ---
আমাদের হৃদয়ের  প্রিয় এই গোপন "তুমি"টা।


রামচন্দ্র সরকার ( বাংলাদেশ )


।।ভাষা।।

ভাষা হলো -শব্দের সাহায্যে ভাবের অভিব্যক্তি বা কল্পরচিত ইচ্ছা প্রকাশের মাধ্যম।

ব্যকরণের ভাষায়-যে ধ্বনি মানুষের বাগযন্ত্রের সাহায্যে গঠিত হয় এবং যার দ্বারা মনের আবেগ -অনুভূতি অথবা মুখ গহ্বর থেকে তৈরিকৃত অর্থবোধক শব্দ সংকেতের সাহায্যে  একে-অপরের সাথে মনের ভাব বিনিময় করা হয় তাকেই ভাষা বলে।
মানুষ যখন কথা বলতে শেখেনি -তখন মানুষ চিত্রকলা,সংকেত, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভাজ-ভঙ্গিমার মাধ্যমে মনের চাহিদা মেটাতো, এবং ক্রমে-ক্রমে -ক্রমান্নয়ে ও বিবর্তনের ধারাবাহিকতার পথ অনুসরণ করে কথা বলতে শেখে।

ঈশ্বর এই বিশাল বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করে যেমন অনন্য প্রসংশার উচচতম শিখরে উঠেছেন ঠিক মানুষও  সভ্যতার সূচনালগ্নে আগুন ও চাকা আবিষ্কার থেকে শুরু করে আজ অবধি  শহর -বন্দর,সুখ-সাচ্ছন্দের সাজসরঞ্জাম, উড়োজাহাজ, মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক এবং বিভিন্ন ধরনের অদ্ভূত আবিষ্কারের ভিতরে ভাষাও মানুষের অবিশ্বাস্য আবিষ্কার এবং শক্তিশালী মস্তিষ্ক বুদ্ধিসম্পুন্ন প্রতিভার পরিচয়।

আর এই জন্য মানুষ অন্যসব প্রাণীদের চেয়ে অন্য রকমের।
এমন একদিন ছিল যখন মানুষের মধ্যে ভাবের বা ইচ্ছা প্রকাশের মাধ্যম ছিল নানা রকম ঈশারা এবং এর মাধ্যমেই মনের ভাব আদান-প্রদান করতো।

চার্লস ডারউইন বলেছেন, 'এতে কোন সন্দেহ নেই যে ভাষার উৎপত্তি হয়েছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শব্দের ঈঙ্গিতে, প্রাণীদের আওয়াজ ও মানুষের ভাষাগত উচ্চারিত ধ্বণির অনুসরণ ও সংশোধন  করে''
ভাষা হলো -মানুষের এমনই একটি মানসিক প্রক্রিয়া যা কন্ঠনালী,কন্ঠ, জিহবা,দন্ত,তালু, ওষ্ঠ এবং ইত্যাদি থেকে প্রসূত ও এইগুলি থেকেই ধবণির সৃষ্টি এবং অর্থবহ হয়ে মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে।

ভাষার ঐশ্বর্য্যময় সম্ভার হচ্ছে শব্দ ও শব্দের পরে শব্দ বসে হয় ভাষার সৃষ্টি।
মুখ-গহ্বর থেকে সৃষ্ট ধ্বণির চিহ্ন তৈরির দ্বারা কন্ঠনি:সৃত ধ্বণির লিখিত রূপ আজকের এই কাগজের পাতায়। স্থান-কাল পাত্রভেদে বিভিন্ন সম্প্রদায়,গোষ্ঠির ও দল-মতের ভাষার রুপ ভেদ হয়ে থাকে,এই জন্যই পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার ভাষা বিভিন্ন রকমের।

ভাষা কবে থেকে শুরু হয়েছে এর প্রকৃত ইতিহাস খুজে দেখতে হলে আমাদের অন্তত ৫০ হাজার বৎসর পেছনে ফিরে যেতে হবে। 'কত-কত ভাষাবিজ্ঞানি মনে করেন ভাষার ইতিহাস আসলে এর চেয়েও পুরনো'বলেছেন নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভাষাবিজ্ঞানী ম্যাগি টলারম্যান । অবশ্য অনেক ভাষাবিজ্ঞানীদের অভিমত-লক্ষ-লক্ষ বৎসর পুর্বে মানুষ ভাষা শিখেছে কিন্তু লিখতে শিখেছে আজ থেকে ৫/৬ হাজার বৎসর পুর্ব থেকে। এর রূপ চর্চা করতে-করতে আজকের পৃথিবীতে ভাষা এত শোভাবর্ধন করছে কিন্তু পৃথিবীর সব ভাষাই নয়।অনেক ভাষাই পৃথিবী থেকে বিলুপ্তও হয়েছে আাবার নতুন-নতুন ভাষারও জন্ম হচ্ছে।

ফেসবুক ঈক্ষণ



প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা। 



লালন ফকিরের বয়স তখন ১১৬ বছর। তিনি শিষ্যদের ডেকে বললেন, এই আশ্বিন মাসের শেষের দিকে তোমরা কোথাও যেওনা। কারণ পহেলা কার্তিকে গজব হবে। বিষয়টি শিষ্যরা অনুমান করতে না পারলেও আসন্ন বিপদের আশংকা করতে লাগলো।
মৃত্যুর প্রায় একমাস আগে তার পেটের ব্যারাম হয়, হাত পায়ের গ্রন্থিতে পানি জমে। পীড়িতকালেও তিনি পরমেশ্বরের নাম সাধন করতেন, মধ্যে মধ্যে গানে উন্মত্ত হতেন। ধর্মের আলাপ পেলে নববলে বলিয়ান হয়ে রোগের যাতনা ভুলে যেতেন।
এসময় দুধ ভিন্ন অন্য কিছু খেতেন না তবে ইলিশ মাছ খেতে চাইলে শিষ্যরা বাজার থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে আসে। দুপুরে সাধন ঘরের সামনে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয়। বিকেল থেকে শুরু করে সারারাত লালন তাঁর শিষ্যদের শ্বাশ্বত বাণী শোনা, মাঝে মাঝে গাওয়া হয় তাঁর গান। রাতে আলোচনা শেষ করে লালন সাধন ঘরে ফিরে গেলেন বিশ্রাম নিতে। শিষ্যদের বললেন, আমি চললাম।
লালন চাদর মুড়ি দিয়ে বিশ্রাম নিলেন, শিষ্যরা মেঝেতে বসে থাকলেন। এক সময় লালন কপালের চাদর সরিয়ে বললেন, তোমাদের আমি শেষ গান শোনাবো। লালন গান ধরলেন, গভীর অপরূপ সুন্দর গান-
পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে।
ক্ষম হে অপরাধ আমার
এই ভবকারাগারে।
গান শেষ হলো, চাদর মুড়ি দিয়ে চিরদিনের জন্য নিরব হয়ে গেলেন ফকির লালন। ফকির লালনের জন্ম সাল জানা যায়নি, তিনি পহেলা কার্তিক ১২৯৭ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৭ অক্টোবর ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান এবং তিনি বেঁচে ছিলেন ১১৬ বছর।