Monday, February 6

ডাক্তার সমুদ্র সেনগুপ্ত



যোদ্ধা জাত 

মেদিনীপুর, ময়মনসিংহ, মুর্শিদাবাদ, কলকাতা, যশোর, পাবনা, বর্ধমান, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর। এই নামগুলোর মধ্যে কোনো মিল পাচ্ছেন ? কোনো যোগসূত্র ? আছে। আছে। কি আছে দেখা যাক।

ব্রিটিশদের তৈরি মিলিটারি ডক্ট্রিন বা নীতি অনুযায়ী ব্রিটিশ রাজ এর আমলে ভারতীয়দের দুটি ভাগে ভাগ করা হয় যোদ্ধা-জাত বা মার্শাল কাস্ট এবং না -যোদ্ধা জাত বা নন-মার্শাল কাস্ট। এই নীতি অনুসারে সৈন্যবাহিনীতে নিয়োগ করা হত। এই নীতি তৈরির ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের কোন মনোভাব কাজ করেছিল সে নিয়ে দুটি হাইপোথিসিস আছে। একটি ব'লে যে যারা সাহসী, খাটিয়ে ও লম্বা চওড়া দেহের অধিকারী তারা হল যোদ্ধা জাত আর যারা একটু শুয়ে বসে দিন কাটাতে অভ্যস্ত তারা নয়। আরেকটি হাইপোথিসিস বলে যে ওসব বাজে কথা। ওই ভাবে ভাগ করার আসল মানদন্ড ছিল কাদের মধ্যে বিদ্রোহ করার সম্ভাবনা বেশি আর অন্যদিকে কারা বেশি অনুগত বা লয়াল থাকবে ব্রিটিশদের প্রতি। স্বাভাবিক ভাবেই ওই মানদন্ড অনুসরণ করেই সিপাহী বিদ্রোহ এর পরে বেঙ্গল আর্মি এর অধিগত এলাকা বা ক্যাচমেন্ট এরিয়া থেকে নিয়োগ ক্রমে ক্রমে বন্ধ হয়ে যায়। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জর্জ ম্যাকমান এর ভাষায় "আমাদের গোটা ব্যবস্থাটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে যদি একবার এই অনুভূতিবোধ জেগে ওঠে যে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়ে ব্রিটিশদের সেবা করা একটা লজ্জাজনক বিষয়।"

 মুশকিল হল অন্য জায়গায়। সেই হীরক রাজার দেশের মতো "যত বেশি জানে, তত কম মানে" এই যুক্তি ধরে নিয়ে আপনি ওই "কম জানা" বা স্বল্পশিক্ষিতদের দিয়ে অনুগত সৈনিক বাহিনী না হয় বানিয়ে ফেললেন কিন্তু ওই সব সৈনিকদের মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন অফিসার খুঁজে পেতে আপনার তখন কাল ঘাম ছুটে যাবে। জেফ্রি গ্রিনহান্ট এর ভাষায়, এই 'যোদ্ধা জাত' থিওরির মধ্যে একটা অদ্ভুত সুন্দর ভারসাম্য আছে। ভারতীয়দের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান ও শিক্ষিত, সেই সব জাতকে "ভীরু" বা কাওয়ার্ড বলে দেগে দেওয়া হল আর যারা অশিক্ষিত, পিছিয়ে পড়া জাত তাদের বলা হল "সাহসী" বা ব্রেভ।

এতটা পড়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন সেই সময়ের সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বঙ্গদেশে বসবাসকারী আমাদের পূর্বপুরুষ ভেতো, শিক্ষিত, ঘাড়-ট্যারা বাঙালির কপালে ওই মিলিটারি ডকট্রিন অনুযায়ী কোন জাত এর তকমা জুটেছিল। কিন্তু বাংলায় একটা কথা আছে না, "গরজ বড় বালাই"। তাই হয়েছিল। প্রথম বিশ্বমহাযুদ্ধের সময় প্রচুর সৈন্য দরকার ব্রিটিশদের। সেই সময়ের বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল স্বয়ং আসরে নামতে বাধ্য হন। ঢাকায় লেজিসলেটিভ কাউন্সিল এর নিটিং শেষে আগস্ট ১৭, ১৯১৬, আবেদন রাখলেন বাঙালি যাতে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেয় দলে দলে। বাবু বলে যতগুন পারিষদ শতগুন। জমিদার, নায়েব, নেতা, হাতা সবাই মাঠে নেমে পড়লো সৈন্য জোগাড় করতে। ফোর্ট উইলিয়াম এ জোরকদমে চলল নিয়োগ প্রক্রিয়া। তৈরি হল ইতিহাস। তৈরি হল "বেঙ্গলি ডাবল কোম্পানি" ২৬শে জুন, ১৯১৭ সাল। পরে এর নাম হয় ৪৯তম বেঙ্গলি রেজিমেন্ট। 

এটা ইতিহাস এই কারণেই যে এটা আর পাঁচটা রেজিমেন্ট থেকে অনেক অর্থে ব্যতিক্রমী ছিল। মূলতঃ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের যুবকরা যোগ দিয়েছিল। বেশ কিছু গ্রাজুয়েট, ও মাস্টার্স করা ছেলে ছিল। জমিদার বা নবাব পরিবারের ছেলেও ছিল কিছু। এইসব তখনকার দিনে ভাবাই যায় না। নৌসেরা তে প্রশিক্ষণ পাওয়ার পরে এই বাহিনীর একটা অংশ কে পাঠানো হয় করাচি হয়ে মেসোপটেমিয়া। তারপরে বাগদাদ। আজিজিয়া আর আল কূট। বাসরা। এপ্রিল ১৯১৯ এ কুর্দিস্তান। ৩০শে আগস্ট, ১৯২০ সালে ভেঙে দেওয়া হল এই বাহিনীকে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। কলেজ স্কোয়ার এ গেলে আজও দেখতে পাবেন ১৯২৪ সালের আগস্ট মাসে তৈরি করা সেই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। ব্রিটিশরা একেবারে অকৃতজ্ঞ বেঈমান জাত ছিল না। সেই স্তম্ভ এর তিন দেওয়াল জুড়ে লেখা আছে ৪৯ জন বাঙালি সৈনিক এর নাম যারা দূর বিদেশের মাটিতে এক বিদেশি শক্তির হয়ে অন্য বিদেশি শক্তির সাথে লড়াই তে প্রাণ দিয়েছিলেন। এরা সেই মেদিনীপুর, ময়মনসিংহ, মুর্শিদাবাদ, কলকাতা, যশোর, পাবনা, বর্ধমান, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর এর ভেতো বাঙালি। এরা সেই বাঙালি ছেলের দল যারা কবিতা লেখার কলম ছেড়ে হাতে তুলে নিয়েছিল রাইফেল। দেখিয়ে দিয়েছিল যে বাঙালিও লড়তে জানে, মরতে জানে, মরার আগে পাল্টা দু ঘা দিতে জানে। দেখিয়ে দিয়েছিল বাঙালির বাচ্চার রক্তের তেজ।

সেই বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর নেই আমার নিজের দেশের মাটিতে। তার স্মৃতি মুছে ফেলেছে দেশের সরকার। প্রচার খালি যে বাঙালি ছেলের দল কেবল কবিতা লিখতে পারে। ৭১ এর যুদ্ধে বাঙালি আবার জেগে উঠেছিল। কবিতা লেখা ছেড়ে হাতে তুলে নিয়েছিল রাইফেল। দেখিয়ে দিয়েছিল যে বাঙালিও লড়তে জানে, মরতে জানে, মরার আগে পাল্টা দু ঘা দিতে জানে। দেখিয়ে দিয়েছিল বাঙালির বাচ্চার রক্তের তেজ। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধে পেশাদার সৈন্যবাহিনীর পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিল জনগণের মিলিশিয়া, মুক্তি ফৌজ।তাদের সেই অবিস্মরণীয় বীরত্ব এর কাহিনী আসলে বাঙালি যোদ্ধা জাত নয় এই অপপ্রচারের গালে এক বিরাশি সিক্কা চড়। এই চড়টা কষানোর জন্য আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো ওই যোদ্ধাদের কাছে, তাদের কাছে যারা গেঞ্জি পাজামা লুঙ্গি পরে সাব মেশিনগান কার্বাইন ধরতে ইতস্ততঃ করেন নি। বাঙালি লড়তে জানে না এককালের বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীদের সেই অপপ্রচার এর দ্বায়িত্ব আজ সুচারু ভাবে কাঁধে তুলে নিয়েছে হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান এর স্লোগান দেয়া দিশি সাম্রাজ্যবাদীদের দল। গভীর দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় এটাই যে এই অপপ্রচারের শিকার আমাদের কিছু বাঙালি ভাই বোনেরা ও। তারাও সুরে সুর মিলিয়ে বলে যে বাঙালি নাকি যোদ্ধা জাত নয়। তাদের বলি, ইতিহাস পড়ুন, নিজের দেশ ও জাতিকে জানুন জানান। মনে রাখবেন এপার বাংলার কবির কথায় আর ওপার বাংলার সুরকারের সুরে সেই গানের লাইনগুলি যে গান কেবল বাঙালি বানাতে পারে। 

"মোরা নতুন একটি কবিতা লিখতে যুদ্ধ করি
মোরা নতুন একটি গানের জন্য যুদ্ধ করি
মোরা একখানা ভালো ছবির জন্য যুদ্ধ করি
মোরা সারা বিশ্বের শান্তি বাঁচাতে আজকে লড়ি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি
মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি"

No comments:

Post a Comment

লেখা পড়ুন এবং মতামত জানান ।