Thursday, September 15

মঙ্গল কাব্যের সামাজিক মূল্য





মাসুম খান

বাংলাদেশের গ্রামীণ জনজীবনের সঙ্গে মঙ্গলকাব্য উৎপত্ত ভাবে জড়িয়ে আছে। এই মঙ্গল কাব্যগুলি বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসে ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য

বলেন, ‘খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত কবি ভারত চন্দ্রের সময় পর্যন্ত বঙ্গসাহিত্য যে বিশেষে এক প্রকার সাম্প্রদায়িক (sectarian) সাহিত্য রচিত প্রচলিত হয়। তাই বঙ্গসাহিত্যের ইতিহাসে মঙ্গলকাব্য নামে পরিচতি।’সময় বিচারে মঙ্গল কাব্যের সময় ধার্য হলেও খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর পূর্বেই মঙ্গল কাব্যের ধারা সূচিত না হয়ে থাকলে হঠাৎ করেই মঙ্গল কাব্য বাঙালির সাহিত্য আসরে উপবেশন করে না। মঙ্গল কাব্যের সাহিত্য উপদান পূর্ববর্তীকালের ব্রতকথা, পাঁচালীর মধ্যেই নিহিত ছিল এবং অষ্টাদশ শতকের পরেই মূলত বিশ শতাব্দীতেই রচিত হয়েছিল মনসা মঙ্গল জাতীয় কাব্যধারা। সুতরাং বলা চলে, বাঙালি জীবন ধারায় প্রবাহিত হয়েছে মঙ্গলকাব্যের প্রবাহ ধারা।
শ্রীভূদেব চৌধুরীর মতে, বাংলাদেশ আর্য অধিকারভূক্ত হবার আগে থেকেই তখনকার আদিম জনগণ নিজ নিজ চিন্তা-ভাবনা ও জ্ঞান-বুদ্ধি অনুসারে তাদের সমাজ-ব্যবস্থা, আচার-ব্যবহার ও জীবন যাত্রা-পদ্ধতির অন্যান্য উপাদানের পুর্ণায়ত পরিকল্পনা করতে পেরেছিল। বলা বাহুল্য, ধর্মাদর্শ এবং দেবদেবীগণের পরিকল্পনাও তার থেকে বাদ পড়েনি।’
বঙ্গদেশে সেনদের রাজনৈতিক পরাজয়ের ফলে নদীয়াসহ নদীয়ার আশপাশের বঙ্গ সমাজের সব শ্রেণির সাম্প্রদায়িক লোক তাঁদের নিজ নিজ উপস্যদেবতার কর্তৃক প্রকাশ্যে করতে পারলেন এবং তাঁরা তাঁদের উপাস্য দেবতাদের গুণকৃর্তন লিপিবদ্ধ শুরু করলেন তাঁদের মাতৃভাষায়। কেননা, ইতোপূর্বে সেন শাসনামলে লোকভাষা ও লোকদেবতা ছিল নিষিদ্ধ; বৈদিক দেবতা ও সংস্কৃতভাষা সেন শাসনামলের পূজ্য ও রাজমহিমান্বিত। সুতরাং এই সময়ে এসে এ অঞ্চলের সাম্প্রদায় গুলি নিজ নিজ উপাস্য দেবতার গুণকর্তৃন করতে এবং দেবতার প্রাধান্য বিস্তার করতে রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। ‘মঙ্গলকাব্যের উদ্ভব যুগের রচনাবলি দেখে মনে হয়। ঐ সময়ে মনসা, চণ্ডী এবং ধর্মের উপাসকেরাই এ বিষয়ে র্সবাপেক্ষা তৎপর হয়েছিল।’ তবে, শ্রীভূদেব চৌধুরী আরো বলেন, নানা প্রকার অনার্য পরিকল্পনা থেকে উদ্ভূত এইসব দেব দেবী তুর্কি আক্রমনের অব্যহিত পরবর্তী কালে জাতির মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে আর্য সমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিল’ বলে যে মন্তব্য করা হয়েছে, তা মোটেই ঠিক না। কারণ, এই সব দেব-দেবী উপাস্য লোকেরা নিজেদের কখনোই আর্য বলে দাবী করেনি। এখানো তাঁরা নিজেদের সনাতনি বলেই মনে করেন। যা তাঁরা সন তারিখের পর্ব থেকে পুরুষ পরম্পর সামাজিক রীতি নীতি হিসেবে পেয়ে আসছে বা করে আসছে। দ্বিতীয়ত: আর্যাবর্তের লোকেরা বা আর্যরা কখনোই বঙ্গীয় ব্রাহ্মণদের আর্যত্ব মেনে নেননি বলে জানিয়েছেন নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস আদি পর্ব’ গ্রন্থে। তৃতীয়ত: বঙ্গভূমির লৌকিকদেবতা, জৈন ও বৌদ্ধদের ধ্বংস করতে ত্রিপুরার রাজা ক্রিরিট (ধর্ম্মফা) মাত্র পাঁচঘর ব্রাহ্মণ আনিয়ে ছিলেন আর্যাবর্ত থেকে (বর্তমান পাঞ্জাব)। সুতরাং বলা চলে যে, সেন শাসনামলে বিদেশী সেন শাসকেরা ছাড়া বড়জোড় দু’চার ঘর ব্রাহ্মণ এদেশে থাকলেও থাকতে পারে, যা সনাতনী বা লৌকিক ধর্মাচারীদের তুলনায় সামান্য। তাই বলা যায়, এ সময়ে লৌকিক (অনার্য) ধর্মাচারী লোকদের মনস্তাত্ত্বিক শক্তির জোড়েই তাঁরা পরাধর্ম গ্রহণ করেননি বরং সুযোগ পেয়েই তারা নিজ ধর্মের কৃর্তন শুরু করেছেন এবং তা প্রচার করেছেন।
বঙ্গ অঞ্চলে প্রথমে জৈনধর্ম ও পরে বৌদ্ধধর্ম দর্শন প্রবেশ করে। এ সময়ে এ অঞ্চলে বৈদিকধর্ম দর্শন প্রবেশ না করলে জৈন ও বৌদ্ধ দর্শন শুরু থেকে বৈদিকধর্ম দর্শন ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরোধী ছিলো। বৌদ্ধ দর্শনে বঙ্গীয় লৌকিক ধর্মাচরণ প্রাধান্য বিস্তার করে। শেষ পর্যন্ত এমন একটা সময় আসে তখন পূর্ব ভারতীয় তন্ত্র এবং তান্ত্রিকচারণের ফলে বৌদ্ধ দর্শন পিছু হঠতে থাকে। সে অন্য প্রসঙ্গ। এ দেশে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রবেশ মূলত সেনদের হাত ধরে, তাঁদের পূর্ববর্তী কোনো ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্ভী শাসকের সন্ধান আপাদত বঙ্গীয় অঞ্চলে মিলে না।
সেনেরা বঙ্গ অঞ্চলের সামান্য একটা অংশের শাসক ছিলেন এবং তাঁরা তাঁদের অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রচার-প্রসার করতে গিয়ে যুগযুগান্তরের বঙ্গীয় ধর্ম ব্যবস্থাসহ সামাজিক রীতি নীতির উপর যে জুলুম শুরু করে, তাই ছিল তাঁদের কাল। অবশ্য ব্রাহ্মণ্য বাদী ঐতিহাসিক এবং সাহিত্যিকেরা সেনদের সামাজিক অবক্ষয় চাপা দেবার চেষ্টায় সচেতন ছিলেন। এমন কি, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে- অম্বিকারচণ ঘোষ, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা সেনদের সামাজিক ব্যবিচার ধর্মীয় প্রশংসার চোখে দেখেছেন। এ সব ব্যবিচার অন্যায়কে প্রসংশার চোখেই দেখা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়Ñ কৌলিণ্য প্রথা’র কথা। এ প্রথায় সামাজিক ব্যবিচার সর্বশেষ সীমায় পৌঁছালেও ব্রাহ্মণ্যবাদী ঐতিহাসিকের এ রীতি-ব্যবস্থার প্রসংশা করেই তাঁদের ইতিহাস রচনা করেছেন।
বৈদিক যুগ থেকে মহাভারতের যুগ পর্যন্ত ভারতীয় নারী-সমাজ, সমাজে সর্বচ্চ মর্যাদা প্রাপ্ত ছিলো। রমায়ণ যুগে এসে নারীর সত্বীত্বের প্রশ্ন উঠলো। ‘শ্বেতকেতু’ তাঁর পিতা মাতার সঙ্গে বসেছিলেন। এমন সময় এক ব্রাহ্মণ এসে তাঁর মাকে যৌন আবেদন করে এবং যৌন ক্রিয়ার জন্য অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনাকে শ্বেতকেতু ব্যবিচার বলে মনে করেন এবং পরবর্তী কালে তিনি ঋষি হয়ে পরনারীর পাণি প্রার্থিতা রোধকল্পে বিবাহ ব্যবস্থা প্রচলন করেন এবং সিঁদুর হয় বিবাহের চিহ্ন। সিঁদুর পড়া কোনো নারীর পাণি প্রার্থি যেন আর কেউ না করেন। স্মৃতি যুগে এসে নারীর মর্যাদা ধ্বংস হয়ে পরে। নারী তখন শুধু সন্তান উৎপাদনের মাধ্যম মাত্র। আর তার কোনো পরিচয় যেন নেই এবং নারীর বিবাহ ব্যবস্থার আয়োজন হয় প্রথম রজ: সময় থেকে।
স্মৃতি যুগের শেষের দিকে এসে দেখা যায়, নারীর বিবাহ দিতে আদেশ করা হয়েছে ঋতু শুরুর আগেই। তা না হলে অবিবাহিতা নারীর ঋতুরক্ত তাঁর পূর্ব পুরুষ যারা পরলোকগত তাদের নাকি পানতে হবে। এসব সামাজিক ব্যবস্থাকে সেনেরা পুনরায় চালু করেন এবং কুলিন বৃদ্ধ’র কাছে অভাবি পিতা কন্যা দানে বাধ্য হয়। শ্রীভূদেব চৌধুরী মতে, এ সময়ে অভিজাত সমাজের মধ্যেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মাচরণের প্রতাপ ও মহিমা অনেকটাই সীমাবদ্ধ ছিল। বিশেষ ভাবে কোনো রাজসভার বিদগ্ধ পটভূমিকায় বাংলাদেশে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম সংস্কারের সার্থক অভূত্থান ও বহুল বিস্তার ঘটেছিল; অন্যদিকে, এ সময়েই জৈন-বৌদ্ধ ধর্মের স্বল্পাবশেষ লোক-জীবনে সহজিয়া সাধনার তলানির মধ্যে এসে আত্মগোপন করেছিল।’ এই উদ্ধৃত অংশ থেকে বুঝা যায়, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম জনসাধারণের কাছাকাছি পৌঁছাতে না পারলেও শাসকদের নিকটবর্তী জনদের কামনা বাসনা চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে তারা তাদের প্রসংশিত সমাজ ব্যবস্থা জনসাধারণের মধ্যে চালু করে হীনস্বার্থ চরিতার্থ করে, তারমধ্যে অন্যতম হলো এই কৌলিণ্য প্রথা। যা দ্বারা কুলিন ব্রাহ্মণ কুমারী নারীর দেহ স্বাদ এবং অর্থ দুটিই ভাল পেয়েছে। রাজভাষা বাংলা না হয়ে সংস্কৃতভাষা হওয়াও ছিল শাসক এবং জনসাধারণের দূরত্বের অন্যতম প্রধান আর একটি কারণ। আর ঠিক এ সময় তলানিতে তলিয়ে যাওয়া আত্মগোপনকারী বাঙালি সনাতনী শক্তি, শাক্ত, বৈশ, শৈব্য, জৈন, বৌদ্ধসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের উদ্ধারের জন্যে ইখতিয়ার কে বঙ্গে ডেকে আনানো হয়।
সেন শাসনামলের সেই চরম মহুর্তে বঙ্গীয় বৃহৎজনগোষ্ঠীর ভেঙ্গে পড়া আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সর্বোপরি যুগযুগান্তরের প্রচলিত লৌকিক ধর্ম রীতি-নীতিকে নতুন করে গঠনের চেষ্টা করা হয়। বখতিয়ারের নদীয়া বিজয়ের ফলে সমাজের উচু নীচু নির্বিশেষে বাঙালি জাতি সেদিন আত্ম শক্তিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। নিতান্ত আহারের মতো দুর্বলের একমাত্র আশ্রয় হয়েছিল দীর্ঘ দিনের অবহেলীত লৌকিক দেব-দেবী আর তাঁদের সেই দেবতা-দেবীর কীর্তনের মাধ্যমও হয়েছিল দীর্ঘ দিনের অবহেলীত মাতৃভাষা বাংলায়। মাতৃভাষায় জীবনাচরণ ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ সেনদের পরাজয়ের মধ্যদিয়েই ঘটেছে এবং ততদিনে কৈরব নরকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বাঙালি কবি কৃত্তিবাস রামকথা রামায়ণ বাংলাভাষায় অনুবাদ করেছেন।
মানুষ সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই দৈব্য শক্তির আরাধনা করে দেবতাদের দ্বারস্থ হয়েছে এবং মানুষ তাঁদের দেব-দেবীর প্রসংশা গীত করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় এসেছে মঙ্গলকাব্য গুলি। এতে যে সকল দেব-দেবীর প্রসংশা গীত হয়েছে তাঁরা কেউ-ই বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দেবতা নয়। সেন শাসনের ভয়ে এসব অবৈদিক, ব্রাহ্মণ্যধর্ম বর্জিত দেব-দেবীরা ঘরের চৌহদ্দির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ঘরের মেয়েরা ব্রতকথা’য় সংসারের মঙ্গলার্থে তাঁদের তপ-জপ করত হাজার হাজার বছর ধরে। সুতরাং ব্রাহ্মণ্য ধর্মবাদী ঐতিহাসিকদের দাবি অযুক্তিক এবং গোপন স্বার্থ সন্ধানি। তাদের অনেক বাক্য সাম্প্রদায়িক বিষ ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। 
আমি ব্যক্তিগত ভাবে যা মনে করি, তা হলো এসব পুরাতন অবিবেচক-মানুষের সামাজিক মূল্যহীন সমাজ ব্যবস্থা বঙ্গীয় সমাজে পুন প্রতিষ্ঠা করার ফলে অব্রাহ্মণ বাঙালি এবং সেনদের বাঙালি সেনা সদস্যরা উদ্যোগী হয়ে উত্তর ভারত থেকে ইফতিয়ার মোহাম্মদ বখতিয়ারকে ডেকে পাঠিয়ে দিলেন। বাঙালির সমাজ ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্যে। যে কারণে, মাত্র আঠার জন সেনা সদস্য নিয়ে বখতিয়ার নদীয়া অঞ্চল দখল করতে পেরেছিলেন। তাদের বিরুদ্রে কোনো অস্ত্র ধরা হয় নি। রক্ত ঝরা তো অনেক দূরের কথা, একটি লোমও করো পড়েনি। সেনদের পরাজয় নির্চিত করেছিল বাঙালিরা, তাই শূন্যপুরাণের বাঙালি কবি খিলজিকে ঈশ্বরের আর্শিবাদ রূপে দেখেছেন।
ব্রাহ্মণ্য ধর্মানুযায়ী সেনদের নদীয়াতে রাজনৈতিক পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় ও বিদেশী যে ক’জন ব্রাহ্মণ ধর্মানুযায়ী এদেশে যে ক’জন ব্রাহ্মণ্য ধর্মানুযায়ী এদেশে ছিল তারা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় উত্থানে চেপে নিজেদের টিকিয়ে রাখতেই আর্যদের পালনিয় ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে অব্রাহ্মণ লৌকিক ধর্ম মিশিয়ে নিজেদের গা বাঁচিয়েছেন, তাই এখন বঙ্গ দেশে ব্রাহ্মণদের ‘গাজন’ কিংবা ‘শক্তি’র উপাসনালয়ে যেতে বাধা নেই- জাতও যায় না। বরং এখন এমন একটি পরিস্থিতি এদেশে সৃষ্টি হয়েছে যে, সনাতনী বা ব্রাহ্মণদের বিবাহ অনুষ্ঠান ব্যতিত কোনো আচরণীয় অনুষ্ঠানেই আর ব্রাহ্মণ্য ধর্মেও কোনো প্রচালন টিকে নেই। সুতরাং এদেশে ব্রাহ্মণ থাকলেও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কোনো কিছুই টিকে থাকেনি।
মঙ্গলকাব্য রচনার একেবারে প্রাথমিক দিকে এর কাঠামোর রূপ প্রাচীন সংস্কৃত পুরাণের আদর্শ সচেতনভাবেই অনুসৃত হয়েছিল, এমন সিদ্ধান্তের অভ্যন্তরীণ প্রমাণ আছে। মঙ্গল কাব্যের প্রারম্ভে ‘বন্দনাংশ’পুরাণের বহুদেবতা বন্দনার আদর্শেই হয়েছে। ঐ অংশে বিভিন্ন দেবতার মাহাত্ব প্রকাশ উপলক্ষ্যে পৌরাণিক শ্লোকের ভাব, এমনকি, অনেক ক্ষেত্রে ভাষাগত ঐতিহ্যকেও অনুবাদ করার চেষ্টা করা হয়েছে। মঙ্গল কাব্যের সৃষ্টিতত্ত্বও অনেকাংশে পৌরাণিক সৃষ্টিতত্ত্বের আদর্শানুগ। অনুরূপ প্রসঙ্গ যেখানে প্রধান ভাবে আর্যতের ঐতিহ্যকে অনুকরণ করেছে, সেখানেও সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণনার মূল কাঠামোটি পৌরাণিক প্রকরণেরই অনুবর্তী।
পুরাণের প্রতি মঙ্গল কাব্য রচয়িতাদের এই পক্ষপাত একেবারেই অকারণ ছিল না। আগে দেখেছি, খ্রিস্টীয় শতকের প্রথম দিকে যখন বৈদিক দেব ধর্মের বিপর্যয় শুরু হয়, তখন অবৈদিক দেবতারা বৈদিক চেতনার অংশ হয়েই মূলত: পুরাণ শাস্ত্রেও সূচনা হয়েছিল। এদিক থেকে, বাংলা মঙ্গল কাব্য ও সংষ্কৃত পুরাণের জন্মের মলূ সাদৃশ্য এক ও অভিন্ন। পার্থক এই যে, লৌকিক দেবদেবীর আচরণীয় ব্রত ও পাঁচালী থেকে বৈদিক ব্রাহ্মণেরা রচনা করেছিল পুরাণ শাস্ত্র আর লৌকিক জীবনধারায় টিকে থাকা অবৈদিক জনগোষ্ঠীর হাতে সৃষ্ট হয়েছে মঙ্গল কাব্যধারা। সুতরাং মঙ্গল কাব্য রচনার যুগ বাংলাদেশে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পরির্বতে নতুন করে লৌকিক ধর্মেও পুনরুত্থানের যুগও বলা চলে। ‘মঙ্গল কাব্যের দেবতারা পৌরাণিক দেবতাদের প্রতিপন্ন করার দিকে আলোচ্য কবিদের লোভ থাকাই স্বাভাবিক। তাই মঙ্গল কাব্য সমূহকে তারা বাংলাভাষায় সংস্কৃত পুরাণের আদর্শে গড়ে তুলতে চেয়েছিল’ এ দাবী যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, ‘প্রাগার্য দ্রাবিড়দের প্রধান দেবতাই ছিলেন- শিব। বৈদিক যুগের রুদ্র, পৌরাণিক যুগের শিবশঙ্কর এবং বাংলাদেশের কৃষিজীবি শিব বাহ্যতঃ একই বলে মনে করেন অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়, তিনি বলেন- কৃষিজীবি অনার্য শিব-ই প্রাচীন। আর্যেরা তাকে গ্রহণ করেছে বিভিন্ন বিবর্তনের মধ্যদিয়ে। লৌকিক ব্রত আর পাঁচালীর যুগেই মঙ্গল কাব্যের দেব-দেবীর প্রতিষ্ঠা হয়েছে, শুধু পৌরাণিক আর মঙ্গল কাব্যের যুগের পরির্বতন হয়েছে মাত্র। জৈন-বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ ধর্মের মাধ্যমে আর্য সংস্পর্শে এসে লৌকিক সমাজের ঐ সব আদিম দেব-দেবী কিছুটা পরির্বতন পরিকল্পিত ও ধর্ম-সংস্কারে, ভাবে ও আচার-আচরণেও কিছু বিবর্তন এসেছে। তাই, মঙ্গল কাব্যের কবিদের পুরাণের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা অনুরাগ ঠিক বলা যাবে না; কেন না, পৌরাণিক যুগ শুরু হয়েছিল এদেশীয় লোক সংস্কৃতিকে আর্যায়ণ করনের প্রয়োজনে পুরাণ রচনা করা শুরু হয়ে ছিল। সেই পুরাণে বাংলার জনজীবনের ব্রত বা পাঁচালী দেব-দেবতা-দেবীরা লোকজ জীবন থেকেই সাংকৃত্যায়ণ হয়ে আর্য-ধর্ম-দর্শনে স্থান করে নিয়েছে। ফলে, পরবর্তী কালে যখন সেই স্থানীয় জনগোষ্ঠী আবার সেই ব্রত বা পাঁচালীকে কেন্দ্র করে বৃহৎ রচনার হাত দিলো তখন, কিছু আদর্শ যা সনাতন ধারায় প্রবাহিত- সে সব বিষয়াদি পুনরায় পুরাণগুলির কাহিনীর সাথে মিলতে যেতে থাকলো।
আমরা দেখেছি- রুদ্র, মহেশ্বর, শিশ্ন বা শিব এরা প্রত্যেকই পৃথক পৃথক জনগোষ্ঠীর পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দেবতা।
শিব কোনো কালেই কোনো অবস্থাতেই বৈদিক জনগোষ্ঠীর বা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দেবতা ছিলেন না। ভারতীয় যে সকল প্রাগবৈদিক দেবতা পরবর্তী হিন্দুসমাজেও নিজেদের প্রতিষ্ঠা স্থাপন করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। তাহাদের মধ্যে শিবই সর্বপ্রধান। পৌরাণিক শিব এবং মৌলিক শিব নিজ নিজ স্বরূপে সম্পূর্ণ পৃথক। একজন আর্যাচার-মহিমান্বিত পরমেশ্বও, আর একজন লোকজীবনের দৈন্যের আকর, লৌকিকতার মূর্তিবিগ্রহ।
মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে মঙ্গল কাব্য বিশেষ স্থান দখল করে আছে। শুরু থেকে অষ্টাদশ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই মঙ্গল কাব্য সর্বাধিক ভাবে রচিত ও প্রচারিত হয়েছে, পেয়েছে ব্যপক জনপ্রিয়তা। এখনো পর্যন্ত মঙ্গল কাব্যের দেব-দেবীদের পূজা ঘটা করে বৃহৎ বঙ্গদেশে পালিত হয়। পঞ্চাদশ শতাব্দী নয়, তাওরা আগে ত্রয়োদশ শতক থেকেই মঙ্গল কাব্য রচনা শুরু হলেও এই কাব্যের জীব ছিল প্রাগৈতিহাসিক কালের বঙ্গভূমিতে। মহিলাদের ব্রত পালন, ছড়া আর পাঁচালী ছিলো তার মাধ্যম। যুগে যুগে মানব কল্যাণে ও পারিবারিক শান্তি কামনায় প্রচলিত ছিল এই ব্রত আর পাঁচালী। সুপ্রাচীন কাল থেকেই বাংলার লোক সাধারণ তাদের নিজস্ব আদর্শ অনুসারে নিজ নিজ লৌকিক দেবতাদের পূজা পদ্ধতি ও মহিমাগাঁথা কাহিনীর প্রচলন করে আসছিল। বলা বাহুল্য, সে পূজা-পদ্ধতি এবং মহিমা বোধ প্রকাশের ভাব এবং ভাষা; দুই-ই কালের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ও পরির্বধন হয়েছে। এই ভাবে অনুমান করতে বাধা নেই, বাংলাভাষা সাহিত্যের আদি যুগের আদি ভাষায়, অÑগঠিত কাব্যে ঐ সকল লৌকিক দেব-দেবীগণের মহিমা গাঁথা পাঁচালীর আকারে প্রচলিত হয়েছিল। আর পণ্ডিতগণ মনে করে থাকেন, পরে ত্রয়োদশ শতাব্দীর যুগপ্লাবী প্রয়োজনের প্রভাবে, এই পাঁচালী কাব্য ধীরে ধীরে পরিণত মঙ্গল কাব্যের আকার ধারণ করেছে। ‘মঙ্গল’ শব্দটিও বৈদিক বা বৈদিক পরবর্তী সংস্কৃত শব্দ নয়। ‘মঙ্গল’ খাঁটি দেশীয় (অনার্য) শব্দ এর আর্থ ‘ভাল’ বা ‘কল্যাণ’, যে কাব্য, গান বা গীত প্রচার, রচনা বা গাওয়া অথবা শোনলেও দেবতা খুশি হন এবং কল্যাণ করেন, তাই হল ‘মঙ্গল কাব্য’। মঙ্গল কাব্য সমূহের অভ্যন্তরিক প্রমাণ অনুসরণ করে বলা চলে, যে দেবতার আরাধনা মাহাত্ম কীর্তন, এমন কি শ্রবণের মঙ্গল হয় এবং বিপরীতটিতে হয় অমঙ্গল; যে কাব্য মঙ্গলাধার, এমনকি, যে কাব্য ঘরে রাখলেও মঙ্গল হয়, তাই মঙ্গল কাব্য। মঙ্গল কাব্যের সাহিত্যিক আঙ্গিক বিবর্তনের ইতিহাস অনুধাবন করলে একথা স্পষ্ট অনুভব করা সম্ভব যে, সমাজ জীবনের নিষ্টাপূর্ণ অনুসরণ ও রূপায়ণই এই মঙ্গল কাব্য শ্রেণির রচনাকে ক্রমশ মধ্যযুগের জাতীয় সাহিত্যের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। অন্যপক্ষে এই একই বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে লোকজীবন সম্ভূত এই কাব্য প্রবাহ জাতীয় ইতিহাসের বহু উপকরণের ধারক হয়ে দেখা দিয়েছে। মধ্যযুগের বাংলার জীবন-ইতিহাসের বহু অপ্রাপ্ত তথ্যের শূন্যস্থান পূরণ করেছে মঙ্গল কাব্যে প্রাপ্ত জীবন ঐতিহ্যের শিল্পরূপ।

বাংলাদেশসাহিত্য গবেষক

No comments:

Post a Comment

লেখা পড়ুন এবং মতামত জানান ।