Monday, October 17

মুহাম্মদ ইয়াকুব ( বাংলাদেশ )


আত্মোপলব্ধি 


সাহিত্য মানব মস্তিষ্কে সৌন্দর্য, সুকুমার ও মহাত্ম্যপূর্ণ চৈতন্যের চাষ করে। পঙ্কিল মৎসর মানস এই অঙনে শ্রীহীন। এখানে কলমের ডগায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ঘটে যাওয়া, ঘটমান বা অনাগত ভবিতব্য বিষয়াদি দ্বিধাহীন প্রকাশ করার ব্যাপার সম্পৃক্ত থাকে। শক্তিমান কলমের ক্ষুরধার আঘাতে ইস্পাতকঠিন বিপ্রতীপ পাহাড় প্রকীর্ণ-বিদীর্ণ হয়। দুর্বল হাত প্রকম্পিত হয় অন্তর্ভেদী দর্পনের সামনে। সম্মুখ আলাপচারিতায় বিভক্তিরেখা প্রকট হয়ে দেখা দেয় প্রাজ্ঞ ও অপ্রতুল মননের মানুষের মাঝে।

সাহিত্যে আত্মতুষ্টি মারাত্মক এক ব্যাধি। বাংলার মানুষ আবেগের ঘোড়া দাবড়ায়, বিবেককে নিক্ষেপ করে নিশুতি আস্তাকুঁড়ে। অবচেতন মননে উচ্চাকাঙ্খী কিন্তু অশুচি স্বপ্নীল প্রাসাদ নির্মাণ করে যায়। পলাশী থেকে একাত্তর পর্যন্ত হযবরল সংগ্রামের ইতিহাসও দ্বিধাহীন চিত্তে তাই স্বীকার করে স্বীকারোক্তি প্রদান করে। হঠাৎ আত্মসম্মান বাঁচানোর প্রয়াসে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে পরক্ষণে আত্মবিক্রয়ের মিছিলে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। মূলস্রোতের সাথে সঙ্গতি রেখে আমাদের সাহিত্যকর্মীরা স্রোতের অনুকূলে নিজেদের কলমকে ভাসিয়ে দেয়। চলমান স্রোত অন্যায়-অসত্যের পক্ষে হলেও প্রতিকূলে চলার সৎ সাহস আমাদের নেই। তোষামুদে চেতনায় আঘাতপ্রাপ্ত হলেই একশ্রেণীর সাহিত্যকর্মী বলে বসেন, এটি রাজনীতির অঙন নয়। অথচ একজন প্রকৃত সাহিত্যকর্মী চলমান অন্যায়-অসঙ্গতির বিপক্ষে বলবেন, এটি খুবই স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত বিষয়। সাহিত্য রাজনৈতিক হাতিয়ার না হলেও রাজনীতি সচেতন। কিন্তু, আমাদের আত্মোপলব্ধির তথৈবচ সময় নেই। আমরা সাহিত্যমান নির্ণয়ে সচেষ্ট না হয়ে সাহিত্যকর্মীর লেখার বিষয়বস্তু এবং ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই। একটি ট্যাগ লাগানো গেলেই হলো ; তাঁর আর কোন মর্যাদা নাই, নাই কোন ভবিষ্যৎ! 

সাহিত্যের অশ্মরী আত্মা জীবন্মৃত। সতেজতাহীন কলমগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। নিজেদের বিবেকে অন্যের চিন্তাধারা প্রতিস্থাপিত হলে নিজস্বতা অর্জন অসম্ভব হয়ে পড়ে। অন্যের চিন্তাধারা বুকে ধারণ করে নির্লজ্জ মিথ্যাচারে লিপ্ত হওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর থাকে না। বিদ্যমান গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসমান সে সকল ব্যক্তি কলমকে কাঁচিতে রূপান্তর করে সৌনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ধ্রুব সত্য হলো, স্খলিত মননে উর্বরতা থাকে না, কলমে বিদ্যুদ্বেগ থাকে না, অন্তরীক্ষে প্রতিবোধিত প্রজ্জ্বলন থাকে না। এমন রুদ্ধ চৈতন্যে সুকুমারবৃত্তির প্রাণিধান অকল্পনীয়। এই শ্রেণির সাহিত্যকর্মীরা সময়ের প্রয়োজনে কচুরিপানার মতো ভেসে উঠলেও মহাকালের নিরীক্ষায় সন্দেহাতীতভাবে অতলে তলিয়ে যাবে। 


সাহিত্য সমাজে পশ্চাৎমূখী চেতনা উত্তরাধুনিকতার সংক্রম টেনে ধরেছে। কেউ এগিয়ে গেলে লম্বিকা টেনে ছিঁড়ে নেবার প্রয়াস বেশ লক্ষণীয়। অতীতমুখী প্রবণতা কখনও স্বকীয়তা ও নিজস্বতা প্রবর্তনের সক্ষমতা রাখে না। একজন সাহিত্যকর্মীর সবচেয়ে বড় অলঙ্কার হলো তাঁর নিজস্বতা ও স্বকীয়তা। এই ক্ষেত্রে আমাদের কোন নতুন অর্জন নেই বললেই চলে। তাছাড়া বর্তমানে সাহিত্য মূল্যায়নের মাপকাঠি পদক-ভূষণে সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে আমরা নিজেরাই কম দায়ী নই। পদক-খেতাবের লোভ একশ্রেণির তোষামুদে কলম সম্প্রদায় সৃষ্টি করে। এরা আসলে কলম, নাকি বকলম তা নিয়ে বিস্তর মতপার্থক্য আছে। পদক-খেতাব যে সাহিত্যে অমর হওয়ার মাধ্যম নয়, সেকথা তাদের বুঝাবে কে! রবীন্দ্রনাথ একমাত্র নোবেল ছাড়া আর কী পদক পেয়েছেন? আমাদের জাতীয় কবির ঝুলিতে কত শত পদক জমা পড়েছে? মাইকেল মধুসূদন দত্ত কোন কোন পদক অর্জন করেছেন? বাংলা সাহিত্যে নজরুলের পর সর্বাধিক সাহসী লেখক আহমদ ছফা জীবিতাবস্থায় কোন পদকই পাননি! তাঁর মৃত্যুর পর একুশে পদক প্রদান করা হলেও অন্য কোন রাষ্ট্রীয় পদক এই অসাধারণ ধীমান লেখকের পদচুম্বন করে ধন্য হতে হতে পারেনি। এই ক্ষেত্রে ছফা বঞ্চিত হয়েছেন এমন নয়, বরং ঐ পদকগুলোই তাঁর পদস্পর্শ করতে না পারার লজ্জায় লজ্জিত হয়েছে। অথচ এই ছফার কথার তেজে রাষ্ট্রশক্তির হাঁটু পর্যন্ত থরথর কাঁপতো! পদকের পরশ পাথুরে গুণ নয়, নিজেদের কর্মের সৃজনশীলতা ও নিজস্ব ঢংই তাঁদেরকে জীবিত রেখেছে। আমরা কি কখনও এসব নিয়ে ভেবেছি? আমাদের মানসে পদকের সাহিত্যমান নির্ণয়ের ভুল পদ্ধতির চাষ করার কারণে রাজকীয় তোষণনীতি সাহিত্যক্ষেত্রকে কুরুক্ষেত্রে পরিণত করছে। মধ্যযুগ আবর্তিত হয়ে ফিরে আসছে এখনকার তারুণ্যে। সকল প্রকারের দায়বদ্ধতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে অপরিপক্কতার পরিচয় প্রদর্শন পরবর্তী প্রজন্মের বিকাশের পথে বিরাট অন্তরায়। আত্মকেন্দ্রীক স্বপ্নরাজ্য বিনির্মাণে সাহিত্যকর্মীদের পথচলাকে তোষামুদে প্রয়াস বললে অত্যুক্তি হয় না। "ধরি মাছ না ছুঁই পানি" ধরণের মানসিকতা নিঃসন্দেহে পরিত্যাজ্য। সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে দ্রোহের কালি না মাখালে, অন্যায় অবিচারের বিপক্ষে লাল কালি না মিশালে সেটি সৃষ্টির পর্যায়ে থাকে না, অনাসৃষ্টিতে পরিগণিত হয়।

অনলাইনকে কেন্দ্র করে আমাদের প্রজন্ম যত্রতত্র গড়ে তুলছে তথাকথিত সংগঠন ; যাদের বুনিয়াদী শিক্ষা নেই, সাংগঠনিক পদ্ধতি জানা নেই। সেখানে আমরা নিজেদের ফোরামেই স্বীয় প্রশংসায় গদগদে পরিস্রুত হই। তোষামুদে শংসায় আত্মতৃপ্তির ঢেকুর গিলি। তৈলাক্ত সমকালের খেয়ায় চড়ে আমাদের জরা মানসে পাণ্ডিত্য উপচে পড়ে। যার কারণে জ্ঞানের ডালপালা উল্টে দেখার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারি না। এমন করুণ পরিস্থিতি দেখে বিজ্ঞের গলদশ্রু স্রোতস্বিনী নদীর মতো প্রবাহিত হলেও  সাধারণ সমালোচনা পর্যন্ত নিস্পৃহ হয়ে ওঠে। পাছে আবার বিপ্রতীপ ভর্ৎসনার স্বীকার হতে হয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের দলন-পীড়নের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়! বিদগ্ধ কলম সৈনিকের অন্তরীক্ষে রক্তগঙ্গার ক্ষরণ চললেও বাহ্যত নিস্তব্ধতার কারণে মাকাল ফলদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পায়। শুধুমাত্র এই ক্ষেত্রেই নয়, স্বাভাবিক নিরীহ সাহিত্যকর্মেও ঐ সকল অকর্মাদের আস্ফালন বেশ লক্ষণীয়। তৈলের দাপটে লোহাকে সোনা বানাতে এরা দারুণ উস্তাদ। লোহাকে লৌহ ধাতু বলার ক্ষমতা এদের নেই। আর কারো এমন সাহস থাকলেও নিজের দুর্বলতা চিহ্নিত হলে হজম করার সক্ষমতা নেই। এমন তৈল সর্বস্ব যুগে একটি বিষয় অনুধাবণ করা উচিত যে, সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন প্রত্যেক সাহিত্যকর্মীর অপরিহার্য গুণ। 

অধুনালুপ্ত পদ্ধতির প্রতি মাথা নুয়ে প্রণাম করে উত্তরাধুনিকে টিকে থাকা খুব সহজলভ্য হবে মনে করি না। সূর্যোদয়ের সূবর্ণ প্রত্যুশে মধ্যরাতের বিভীষিকাময় স্বপ্ন ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত করতে পারে। জীবনমুখী চিন্তাধারা প্রকট হয়ে না উঠলে বিকাশ অরাধ্য সাধনায়ও সিদ্ধিলাভ সম্ভব হবে না। একটিই প্রত্যাশা- মানবতাবোধ লালিত হোক সকল কলমে।


লেখকঃ ক‌বি ও কথা‌শিল্পী, ঢাকা।


1 comment:

লেখা পড়ুন এবং মতামত জানান ।