Tuesday, August 9

মেঘলা আকাশ

সানু দাস

আজ রবিবার ,ছুটির দিন ।কাজে যাবার তাড়া নেই ।তাই জানালার ধারে চেয়ারে বসে
বাম পায়ের ওপর ডান পা টা তুলে দিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকাতে চোখ বোলাচ্ছে
আকাশ ।বাইরে তুমুল বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ছে শ্রাবনের আকাশে জমে থাকা অভিমানী
মেঘগুলো ।
একে ছুটির দিন তার ওপর আবার বৃষ্টি ; তাই বোধহয় আকাশের শরীরে কেমন একটা
অলসতা ভাব লক্ষ্য করছে আকাশ নিজেই ।
মাত্র ৩০ বছর বয়স আকাশের ।স্কুল মাস্টারীর চাকরী করে ।তার বাবা আর মা
দুজনেই গত হয়েছেন ।স্ত্রী অতসী আর ২ বছরের ছেলে আয়ুশ কে নিয়ে দিব্যি কাটে
তাদের দিন গুলো ।ছোট সংসার ,সুখী সংসার ।
স্ত্রী আর ছেলেকে আকাশ গত পরশুদিন গিয়ে শশুর বাড়িতে রেখে এসেছে ।আজ এই
বৃষ্টির দিনে ওরা দুজন থাকলে বেশ ভালই হতো ।মাছ ভাজা আর বেগুন ভাজা দিয়ে
খিচুড়ি খাওয়া যেত তিনজন মিলে ।কিন্তু কী আর করা যাবে ! আকাশ আবার ভালমতো
রান্নাটা ও করতে পারে না ।তাই আজকে ও তাকে হোটেল থেকেই খাবার কিনে খেতে
হবে ।এই সব কথা চিন্তা করছে আকাশ ,হঠাত এমন সময় দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটা ঢং
ঢং করে ১১টা বাজার জানান দিলো ।জানালার দিকে তাকিয়ে আকাশ দেখল যে বৃষ্টির
গতিবেগ আগের থেকে অনেকটা কমে গেছে ।তাই আর দেরী করা ঠিক হবে না ভেবে আকাশ
একটা ছাতা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল বাজারে যাবার উদ্দেশ্যে ।
বাজারটা অবশ্য বেশী দূরে নয় ,আকাশের বাড়ি থেকে পূর্ব দিকে ১০ মিনিটের হাঁটাপথ ।
বাস স্ট্যান্ডের বিপরীতে বাজারের তিন নম্বর দোকান 'শ্রী হরি হোটেল' ।ওই
হোটেলটা থেকেই আকাশ বেশীর ভাগ সময় খাবার কেনে ।আজকে আকাশ ১ প্যাকেট
বিরিয়ানী এবং কিছু পরিমান শশা আর টমাটো বাজারের অন্য দোকান থেকে কিনে এসে
দাঁড়ালো বাস স্ট্যান্ডের পাশে একটি দোকানে সিগারেট কিনবে বলে ।
হঠাত আকাশের চোখ পড়লো হলুদ রং এর চুড়িদার পড়া একটি সুন্দরী মেয়ের দিকে
।মেয়েটার চোখের নীচে পড়া কালির দাগটা আকাশের খুব চেনা চেনা মনে হল
।মেয়েটাকে চিনতে একটু ও অসুবিধা হল না আকাশের ।মেয়েটার নাম মেঘলা রায়
।কলেজে তারা দুজনে একসাথে পড়তো ।একসময় খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল আকাশ আর
মেঘলার মধ্যে ।
এমনকি একসময় তাদের প্রেমটা শরীর পর্যন্ত গড়িয়েছিল ।তার সবচেয়ে বড় প্রমান
মেঘলার বুকের বামদিকের স্তনের ওপরের তিলটার কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে
আকাশের ।
আকাশ লক্ষ্য করল মেঘলার করুন জলেভরা চোখ দুটো অজস্র প্রশ্ন  নিয়ে তার
দিকেই তাকিয়ে আছে ।মেঘলা আজ ও বিয়ে করেনি ।"যদি দং হৃদয়ং মম ,তদি দং
হৃদয়ং তব " মন্ত্রটা দুজনা মিলে একদিন একসাথে উচ্চারন করলে ও ,আজ তার
কোনো দাম নেই ।
এইসব কথা মনে পড়তেই আকাশের বুকের ভিতরটা কেমন জানি খচখচ করে উঠল ।আকাশের
আর সিগারেট কেনা হলনা ,সে দ্রুত পায়ে বাড়ির পথে রওনা দিল ।এদিকে বৃষ্টি ও
জোরে শুরু হয়েছে ।আকাশ আর পিছনে ফিরে দেখেনি ,যে বৃষ্টির জল আর মেঘলার
চোখের জল কোথা ও মিলে মিসে এক হয়ে গেছে কি না .....

             -: সমাপ্ত :-
খবর

(গল্পের শুরুতেই জানিয়ে রাখি ,রাজর্ষি গাঙ্গুলী বলে চরিত্রটি সম্পূর্ন
কাল্পনিকচ চরিত্র ।বাস্তবের সাথে কোনোরকম সম্পর্ক নেই ।)

আজ শনিবার ।অফিসের ছুটি ।তাই বিগবাজারে এসেছি কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস
মার্কেটিং করব বলে ।মার্কেটিং সেরে কার পার্কিং জোনে নিজের গাড়িটার লক
খুলে ,কেনাকাটি করা জিনিস গুলো গাড়িতে রাখছি ।হঠাত এমন সময় পিছন থেকে
একটা হাত আমার কাঁধে এসে থামল ।পিছনে ফিরে দেখলাম হাতটা আর কারো নয়
,রাজর্ষি গাঙ্গুলীর ।রাজর্ষি আমার কলেজের সহপাঠী ।কলেজ ছাড়ার পর আর
আমাদের দেখা হয়নি ।দীর্ঘ আট বছর পর আজ আবার দেখা হল আমাদের ।সত্যি কথা
বলতে ওকে দেখে আমি খুব খুশিই হলাম ।আমি ওকে কফি খাওয়ার প্রস্তাব দিলাম ।ও
আপত্তি করল না ।আমি রাজর্ষির সাথে রাস্তার পাশের কফি হাউসে প্রবেশ করলাম
।বেয়ারাকে ডেকে দুজনার জন্য দুটো কোল্ড কফির অর্ডার দিলাম ।তারপর আমরা
শুরু করলাম পুরানো দিনের স্মৃতিচারন ।আমি কলেজ পাস করার পর প্রফেসান
হিসাবে বেছে নিয়েছিলাম সফট ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এর জব ।আর রাজর্ষি বেছে
নিয়েছিল সাংবাদিকতার কাজ ।স্থানীয় একটি নামকরা দৈনিক সংবাদ পত্রের একজন
নামী সাংবাদিক রাজর্ষি ।

 বেয়ারা এসে কফি দিয়ে গেল ।কফিতে চুমুক দিয়ে আমি বললাম --"তারপর এখন কী
রকম চলছে তোর ?"রাজর্ষি বলল যে সে এখন ছুটিতে আছে ।অফিসের বসকে ছুটির
কথাটা বলতেই বস রাজি হয়ে গেল ।বসের রাজি হবার অবশ্য একটা কারন আছে
।দিনকয়েক আগে রাজর্ষি ফ্রান্সে গিয়েছিল ।ইউরোকাপের টাটকা খবর সংগ্রহ করবে
বলে ।কাজের সূত্রে রাজর্ষিকে সারা বছর দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াতে হয় ।জাপান
,ব্রাজিল ,দুবাই ,ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি জায়গায় তাকে যেতে হয়েছে কাজের
সূত্রে ।সম্প্রতি রাজর্ষি গিয়েছিল ফ্রান্সে ।সেখানে ফুটবলের সাথে আরো
একটা খবর জোগাড় করে রাজর্ষি ।ফ্রান্সে ইউরোকাপ শেষ হবার দিন কয়েক পর যে
ট্রাক দুর্ঘটনাটা ঘটল ,সেটার কিছু টাটকা ছবি তোলে রাজর্ষি ।হ্যাঁ আপনারা
ঠিকই ধরেছেন ,যে ট্রাকটা ৮৪ জনকে একসাথে পিষে মেরেছে ফ্রান্সের রাস্তায়
।আমি এখানে সেই ঘটনার কথাই বলছি ।সেই দুর্ঘটনার যে ছবি রাজর্ষি তুলেছিল
।সে সব ছবি এবং তথ্যর জন্যই নাকি রাজর্ষিদের সংবাদ পত্রের বিক্রির পরিমান
কয়েক গুন বেড়ে গেছে ।আর ঠিক এই কারনেই রাজর্ষির দিন কয়েকের ছুটি মঞ্জুর
করেছে ওর অফিসের বস ।

 আমি রাজর্ষিকে শুভেচ্ছা জানালাম ওর এই কাজের জন্য ।কিন্তু এরপর রাজর্ষি
আমাকে যে কথাটা বলল ,আমি তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না ।রাজর্ষি
আমাকে বলল যে ও সামনের সপ্তাহে বাংলাদেশে যাবে ।ওখানে নাকি একটা
রেস্তরাতে জঙ্গিরা আক্রমন করবে ।আমি অবাক হয়ে ওকে বললাম --"তুই জানলি কী
করে ?"রাজর্ষি চুপিচুপি চারদিকটা একবার ভাল করে দেখে নিয়ে ,তার মুখটা
আমার কানের কাছে নিয়ে এসে অত্যন্ত নীচু গলায় আমাকে বলল--"দেখ তুই আমার
অনেক পুরানো এবং বিশ্বস্ত বন্ধু ।তাই কথাটা শুধু তোকে বলছি ।আমরা এমন
কয়েকজন সাংবাদিক আছি ,যাদের নেটওয়ার্ক জঙ্গিদের সাথে যুক্ত আছে ।জঙ্গিরা
কখন কোথায় কী করবে ,তার খবর আমাদের কাছে অনেক আগে থাকতেই থাকে ।"সে আরো
বলল মুম্বাই এ অ্যাটাক ,পাঠানকোটে অ্যাটাক .কিংবা পাকিস্তানে শ্রীলঙ্কার
ক্রিকেট টিম বাসের ওপর যে জঙ্গিরা অ্যাটাক করবে ,তার খবর আমাদের কাছে
অনেক আগে থাকতেই ছিলো ।আমি ওকে বললাম --"কিন্তু তোরা এই সব খবর অনেক আগে
থেকেই যদি জানতে পারিস ,তাহলে পুলিশ কে জানাস না কেন ? "এমন সময় ওর ফোনটা
বেজে উঠল ।ফোনে কথাটা শেষে করার পর ও আমাকে জানাল ওর বাংলাদেশের পরিবর্তে
পাকিস্তানে যেতে হবে বিশেষ খবর সংগ্রহের জন্য ।যদি ও বিশেষ খবরটার কথা ও
উল্লখ করল না ।ওদের অফিসের বস অর্ডার দিয়েছে ও যেন এক্ষুনি বেড়িয়ে পড়ে
।যাবার আগে অবশ্য রাজর্ষি আমাকে আমার প্রশ্নর উত্তরটা দিয়েগিয়েছিল ।একটা
নির্দয় হাসি হেসে রাজর্ষি আমাকে বলেছিল--"১২৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে
কয়েকশো মানুষ যদি মরে যায় ,তাহলে কোনো ক্ষতি নেই ।আর তাছাড়া খবর চাইতো
পাবলিকের জন্য ।রঙচঙে রক্ত মাখানো খবর না হলে ,পাবলিক আবার ঠিকঠাক খেতে
চায় না ।"

 বাড়ি ফেরার পথে আমাকে সেদিন খুব সাবধানে গাড়ি ড্রাইভিং করতে হয়েছিল
।খালি একটাই কথা মাথার ভিতরে বারবার ঘুরে ফিরে আসছিল ।রাজর্ষিরা কী করে
এতগুলো মানুষের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারে !! কয়েকদিন পর বাংলাদেশে
রেস্তরার জঙ্গি আক্রমনের খবরটা কাগজে পড়ে ,খুব খারাপ লাগছিল আমার ।কিন্তু
আমার ও তো কিছু করার ছিল না ।কারন আমার কাছে কোনো প্রমান ছিল না ।

দিন ১৫ পরে হঠাত একদিন দেখলাম কাগজে বেরিয়েছে ভারতীয় সাংবাদিক রাজর্ষি
গাঙ্গুলী পাকিস্তানে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসলামাবাদে একটি জঙ্গির
আত্মঘাতী বিষ্ফোরনে প্রান হারিয়েছেন ।খবরটা দেখলাম রাজর্ষি যে সংবাদ
পত্রে সাংবাদিকতার কাজ করত ,সেই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে ।খবরটা পড়ে
আমি মনে মনে ভাবলাম রক্ত মাখানো খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আজ নিজেই রক্ত
মাখানো খবর হয়ে গিয়েছে ।কারন সব খবর আগে থাকতে জানা যায় না ।পাকিস্তানের
বিষ্ফোরনের খবরটা হয়তো রাজর্ষিকে তার বস ইচ্ছা করেই তাকে জানায়নি ।কারন
বস হয়তো চেয়েছিল এবারের রক্ত মাখানো খবরের রক্তটার রং যেন আরো বেশী গাঢ়
হয় ।