Showing posts with label অহর্নিশ. Show all posts
Showing posts with label অহর্নিশ. Show all posts

Thursday, October 13

অহর্নিশ

শান্তিনিকেতনের আকবরী মোহর

সে দিন খুব ঝড় উঠেছিল | সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি | সেই ঝড়ের মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে আম, জাম কুড়োতে আশ্রমের উত্তরায়ণে ছুটে বেড়াচ্ছিল একরত্তি মেয়েটি | কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি সেই ঝড় ক্রমশ ভয়ঙ্কর আকার নেবে | ভয় পেয়ে তারা ছুটতে শুরু করেছিল নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে | একটা বাড়ি সামনে পেয়েই তার দাওয়ায় গিয়ে উঠেছিল | এমন সময়ে মেয়েটির চোখ পড়েছিল বাড়িটার জানালার দিকে | সাদা চুল, সাদা গোঁফ-দাড়ি আর অপূর্ব দু’টি চোখ নিয়ে একজন তাকিয়ে আছেন বাইরে ঝড়ের দিকে। চমকে উঠেছিল মেয়েটি | তাঁকে চিনতে মেয়েটির দেরি হয়নি। এঁকে ঘিরেই তো শান্তিনিকেতন আশ্রম! এঁর গানই তো সে গায় সারাক্ষণ। দূর থেকে তাঁকে অনেকবার দেখলেও এত কাছ থেকে তাঁকে প্রথমবার দেখল মেয়েটি | বুক দুরু দুরু করছে | হয়তো এ বার বকুনি খেতে হবে।

না, তিনি বকেননি। বরং কাছে ডেকে প্রশ্ন করেছিলেন, “গান জানিস?” সে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ জানাতেই তিনি বলেছিলেন, “শোনা দেখি!” মেয়েটি অবলীলায় গেয়ে উঠেছিল তাঁরই একটা গান । মানুষটা মুগ্ধ হয়ে শুনে বলেছিলেন, “ওরে বাবা, তুই এতটা শিখেছিস!” এর পরে তার পরিচয় জেনে নিয়ে বলেছিলেন, “মাঝেমাঝে এসে আমায় গান শুনিয়ে যাস।” এ ভাবেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অণিমা মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎ ঘটেছিল শান্তিনিকেতন আশ্রমের উত্তরায়ণের ‘শ্যামলী’ বাড়ির দাওয়ায়।  সেই বিকেলেই অণিমা নাম বদলে কণিকা রাখলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন সেই অল্প কয়েকজন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীর মধ্যে একজন, যাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গান রেখে গিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে সাহিত্যিক দেবেশ রায় লিখেছিলেন, ‘গায়ক সংগীতটি রচনা করে তুলছেন শব্দ, সুর দিয়ে। ঐ রচনার আগে ঐ সংগীতটি ছিল না। প্রতিটি গাওয়াই মৌলিক রচনা। প্রতিবারই গানটি নতুনতম রচিত হচ্ছে, রচনার প্রয়োজন থেকে গাওয়া হচ্ছে, গাইতে-গাইতে শোনা হচ্ছে। একজনই এই তিন কাজ করছে কোনও অলৌকিক গায়নে। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছিল সেই অলৌকিক গায়ন ক্ষমতা।' 

ছোট্ট মোহরকে খুব ভালবাসতেন গুরুদেব | ব্যক্তিগতভাবে নজর দিতেন তাঁর গানের উপর | শৈলজারঞ্জন মজুমদার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকেই গান গাওয়ার তালিম নিয়েছিলেন মোহর। “গুরুদেবের সান্নিধ্য পেয়েছি সেই থেকেই। যখনই ওঁর কাছে যেতাম তখনই উপহারস্বরূপ হাতে এসে যেত লজেন্স বা বাদাম। আমার নানা দেশের স্ট্যাম্প জমানোর নেশা ছিল। রোজই প্রায় তাঁর কাছে যেতাম স্ট্যাম্প নিতে,” স্মৃতিচারণা মোহরের। 

‘নটীর পূজা’ নাটকে রত্নাবলীর চরিত্রে অভিনয়ের সূত্রে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর ডাক নাম ‘মোহর’ নামে না ডেকে, ‘আকবরী মোহর’ বলে ডাকতেন। এর কারণ বোধহয় সম্রাট আকবরের তৈরি মোহর যেমন তাঁর পূর্ববর্তী সম্রাটদের তৈরি মোহরের থেকে আলাদা ছিল, তেমনই তাঁর সাম্রাজ্যের শক্তির প্রতীক হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বিশাল মুঘল ভারতে। কণিকা তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমে এক দিকে যেমন অন্যান্য গায়কদের থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছিলেন, অন্য দিকে ভারতীয় সঙ্গীতে রবীন্দ্রগানের সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করেছিলেন। 

মহান শিল্পীকে জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য |                                                                     

©  অহর্নিশ - Ahornish 
ছবি - বর্ষা কর্মকার ঘোষ 
তথ্য : আনন্দবাজার পত্রিকা (বাজে করুণ সুরে... এবং শান্তিনিকেতনের আকবরী মোহর প্রবন্ধ)