Saturday, August 13

সম্পূর্ণ

সুনীরা দাস

আজ থেকে কলেজ শুরু আমার।নতুনজীবন শুরু।মন ভীষন খারাপ,সকলেইঅচেনা।পুরোনো বন্ধুদের থেকে আলাদা হয়ে গেছি।কি যে হবে নতুনফ্রেন্ড পাব কি না,পেলেও কেমন হবে কে জানে।এত টেনশনে নিজের নাম বলতে ভুলে গেছি,আমি গোধূলি।কেমিস্ট্রি নিয়ে ভর্তি হয়েছি। সকাল থেকে মায়ের হাজারো উপদেশ দেওয়া শুরু হয়েছে,মন দিয়ে পড়বি,প্রফেসারদের সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বলবি ইত্যাদি।ঠাকুর ও মাকে প্রণাম করে কলেজ যাচ্ছি এখন,অটোও পাচ্ছিনা ধূর,দেরি হয়ে যাচ্ছে।প্রথমদিন দেরী করতে চাইনা তাই হাঁটছি।ঘেমে নেয়ে ডিপার্টমেন্টে এলাম,একি!আমরা মাত্র ৫জন,২জন মেয়ে ৩জন ছেলে।মেয়েটি কেমন হাঁদু পড়াকু গোছের।জিজ্ঞেস করলাম, "কি নাম তোমার?" মেয়েটি ইতস্ততভাবে তাকিয়ে বলে, "আমি সুপ্রীতি"কেমন মার্কস ছিলো কেমিস্ট্রিতে"?সুপ্রীতি বললো ৮৮, আমি মনে মনে ভাবলাম আমার থেকে ৩ বেশি। বলতে বলতেই প্রফেসার এসে গেলেন, সবার ইন্ট্রো নিলেন। তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল প্রথমদিন বলে।
টানা ১৫দিন কলেজ করেছি,ক'দিন যাইনি,৩দিন পর কলেজে এসেছি আজ। সুপ্রীতি বললো,
-"কি রে এলিনা কেন কদিন?"
-"এমনি রে,টিউশান নিবি না?"
-"প্রফেসার ব্যানার্জীকে নিয়েছি,একদিন পড়তেও গিয়েছি।"
"ওহো আমাকে তাহলে আজই দেখা করতে হবে একবার প্রফেসারের সঙ্গে।তুই যাবি সুপ্রীতি আমার সাথে?"
-"হ্যাঁ যাবোরে গোধূলি তুই আমার বাড়ি চলে আসিস।"
সুপ্রীতির বাড়ি পূর্বায়ন ক্লাবের কাছেই।বিকেলে চলে যাবো। বাড়ি ফিরতেই মায়ের পাঁচালি শুরু হয়ে গেলো,একটু রেস্ট করে সুপ্রীতির বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম, বেলের পর বেল বাজিয়ে যাচ্ছি কেউ দরজা খুলছে না,বেশ কিছুক্ষন পর সুপ্রীতি দরজা খুলে নিয়ে গেলো ওর রুমে, বেশ সাজানো গোছানো।
-"গোধূলি আজ বাড়ি নেই প্রফেসার, কাল বরং কলেজে কথা বলে নিস।"
-"আচ্ছা। তোর মা বাবা কই রে প্রীতি?"
গলা ভারী করে বললো, "কয়েকমাস আগে আমি মামাবাড়ি গিয়েছিলাম মামাতো বুনুর সাথে। মা, বাবা দাদা আমকে আনতে যাচ্ছিল,উল্টোদিক থেকে এক ব্রেকফেল করা লরি এসে ধাক্কা দেয় মা বাবা ও ড্রাইভারদাকে। সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়,দাদাও গুরুতর জখম হয়েছিল।পাশের হসপিটাল এ নিয়ে যায় ওইখানের স্থানীয়রা,আমি আর দাদা আছি শুধু" বলেই কেঁদে ফেলে সুপ্রীতি।
জিন্স পরিহিত বছর ২১/২২ এর একটি সুদৃশ্য যুবক প্রীতিকে বুনু বলে ডেকে উঠলো,টিকালো নাক, ভরাট ললাট,নীলাভ দুটি চোখ,ফর্সা রঙ,লাল টিশার্ট ফুটে উঠেছে,এইতাহলে প্রীতির দাদা। সেদিন আর কিছু কথা হয়নি, বাড়ি চলে এলাম। বার বার প্রীতির দাদার মুখটি চোখের সামনে আসছে। কি করে, কি নাম কিছুইতো জানা হলোনা। নাঃ, ঘুমিয়ে যাই। কাল আবার কলেজ যেতে হবে।
সকালে উঠে নাকে মুখে গুঁজে কলেজ গেলাম। একের পর এক ক্লাস হয়ে যাচ্ছে,আজ মন বসছেনা কিছুতে,শুধু চোখদুটি মনে পরছে বার বার।বাড়িতেও মন বসছেনা,কিসের তাড়া আমার এতো! রাতে ভালো করে ঘুমাতেও পারলাম না।
সকালে প্রীতির বাড়ি এলাম।
-"সুপ্রীতি নেই বাইরে গেছে", বললো সে। তারপর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, "নাম কি তোমার?"
আমি মুখ নিচু করে বললাম, গোধূলি,কি নাম আপনার?"
-"সুপ্রভাত"
প্রীতি কিছুক্ষণ পর আসতেই বললাম, "কি রে তুই? মা নেই তাই তোর সাথে থাকবো আজ সারাদিন বলেছিলাম মনে নেই তোর?"
-"হ্যাঁ মনে পরেছে। খেয়াল ছিল না। চল চল আমার রুমে চল"। কথা বলেই যাচ্ছে প্রীতি, আর সুপ্রভাতে মন আটকে গেছে আমার। অদ্ভুত সব ভাবনা উঁকি ঝুকি দিচ্ছে।প্রীতির ধাক্কাতে ঘোর কাটল,
-"চল খেতে চল।"
খাওয়া দাওয়া সেরে ঘরে এসেই প্রীতি ঘুমিয়ে পরল, যদিও ও আমায় কথা দিয়েছিল ঘুমাবে না। অন্য সময় হলে রাগ হতো নিশ্চিত কিন্তু আজ একটুও রাগ হলো না। নিঃশব্দে সুপ্রভাতের রুমের দিকে পা বাড়ালাম, পর্দার পাশ দিয়ে দেখলাম ল্যাপটপ নিয়ে বসে কি যেন করছে, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি জানিনা। প্রীতির হাসির শব্দে আমি ঘুরে তাকালাম আর সেই সঙ্গে প্রীতির হাসির শব্দে সুপ্রভাত ঘর ছেড়ে বাইরে এলো আর বলে উঠল, "হাসছিস কেন তুই!" প্রীতি বললো, "লুকিয়ে লুকিয়ে গোধূলিরানী তোকে দেখছিল।"
কিছু না ভেবে ছুটে ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম,কোন ভাবনা এলোনা আর পালিয়ে যাওয়াই একমাত্র সমাধান মনে হল।এসে থেকে শুধু কেঁদে যাচ্ছি,কি জন্য কাঁদছি জানিনা,শুধু মনে হচ্ছে কি ভাবছে ও আমার সম্পর্কে?বাজে অভদ্র মনে করছে আমাকে হয়তো,খেতেও ইচ্ছে করলোনা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরলাম।সকালে উঠে কেমন যেন লাগছে,লজ্জা নাকি ভয়?কলেজ যেতেও ইচ্ছে করছেনা।তবুও মায়ের জোরে কলেজ যেতে হচ্ছে।আজ প্রীতি আসেনি,যাক বেঁচে গেলাম।বাড়ি ফিরে চুপ করে বসে আছি,হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো,কে এল এই সময়?প্রীতি এসেছে।
-"গোধূলি তুই কি রে! তোর ফোন আমাদের বাড়ি রেখে এসেছিলি আর সেটা বোধ হয় খেয়ালও হয়নি? এই নে,আর আজ চলিরে পড়তে যেতে হবে।" আমি হাত বারিয়ে ফোনটি নিলাম।যে ফোনকে আমি চোখে হারাতাম সেই ফোন ছেড়ে এসেছি তা বুঝতেও পারিনি,কি হচ্ছে আমার সাথে,ফোন হাতে নিলাম,কভারের ভেতরে সাদা কাগজ মতো কি? চিঠি কে দিলো আমায়! চিঠিতে লেখা-
"কাল কলেজ শেষে নদীর পাশে এসো একবার,অপেক্ষা করবো। -সুপ্রভাত।"
সারাদিন কলেজে বসে ভেবে যাচ্ছি যাবো কি না,ঘন্টার শব্দে ঘোর কাটল,আনমনাভাবে হেঁটে চলি। কখন এসে গেছি বুঝতেও পারিনি।ফাঁকা নদীর পাড়,হন্তদন্ত ভাবে সুপ্রভাত ছুটে এসে বলল, "দেরী করে ফেলেছি অনেক তাই না? কিছু কথা আছে তাই এইভাবে ডাকতে হল তোমায়।"
আমি একদৃষ্টে চেয়ে আছি। ও বলতে শুরু করল,
-"আমি পার্টির সাথে যুক্ত,বাঙলা নিয়ে কোনমতে B.A পাশ করেছি,চাকরী খুঁজছি এখন,পাব কি না জানিনা,জেলেও গিয়েছি একবার তাই মুশকিল হচ্ছে চাকরীতে। নাম্বারটি দেবে তোমার?" এইসব শোনার পর কি বলি বুঝতে পারছিনা,নাম্বার দিয়ে বাড়ি এলাম,ঘুমিয়ে পড়েছিলাম,রাত হয়েছে অনেক। ১২টা বাজে,ফোনে ম্যাসেজ এল যে কার এত রাতে,সুপ্রভাত গুড নাইট ম্যাসেজ করেছে,আমি reply করে শুয়ে পড়লাম।
আজ সুপ্রভাতের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি,ও আজ কি বলবে ভেবে ভেবে সারা রাস্তা কাটালাম,আজ ও আগে থেকেই অপেক্ষা করছে,এগিয়ে এসে বলল,
-"কিছু ভেবেছ?" এইভাবে বলবে ভবিনি,উত্তর কি দেবো বুঝতে পারছিনা,
-"কি হল কিছুতো বল গোধূলি?"
-"চাকরী পেলে তুমি?"
দেখছি পাইনি এখনও, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে চলে এলাম,এতো সাহস নেই আমার যে নিজের মনের কথা বলব,কয়দিন কেটে গেল সুপ্রভাত কোনরকম কথা বলেনি আমার সাথে,প্রীতিও বেশ কয়দিন কলেজে আসেনি,অনেক ভেবে প্রীতির বাড়ি গেলাম,আমাকে দেখেই প্রীতি জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করল। জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে তোর? প্রীতি বলতে শুরু করল, "দাদার কয়দিন আগে জ্বর হয়েছিল ব্লাড টেস্ট করে জানা গেল দাদা HIV POSITIVE"। বলেই অঝোরে কাঁদতে শুরু করলো।ছি! এইরকম নোংরা ছেলেকে ভালবাসি আমি, নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলাম,সুপ্রভাত
ের ঘরে গেলাম,সবকিছুর সঙ্গে নিজের আসল নোংরাগুলিকে ভালই ঢেকে রেখেছিলে বেশ,তোমার মুখ দেখতেও চাইনা আর কোনদিন,এই কথাগুলি বলে কোন কথা না শুনে বাড়ি চলে এলাম।রাস্তায় কান্না অনেক কষ্টে আটকে রেখেছিলাম,যা আর বাঁধ মানলনা,মাও নেই আজ,কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে দেখলাম চোখ ফুলে আছে। কিন্তু প্র্যাক্টিক্যাল আছে তাইএকপ্রকার বাধ্য হয়ে কলেজ গেলাম। আজও প্রীতি আসেনি। ক্লাস শেষে বেরিয়ে দেখি দূরে প্রীতি দাঁড়িয়ে।আমাকে দেখে এগিয়ে এল,একসাথে হাঁটছি, হঠাৎ ও বললো,
-"গোধূলি, দাদা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে,লিখে গেছে আমার সুন্দর ভবিষ্যতের অন্তরায় হতে চায়না ,তোকে এই চিঠিটি দিতে বলেছে। এই নে।" চিঠিটি হাতে ধরিয়ে প্রীতি চলে গেলো।বাড়ি এসে চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলাম।
গোধূলি,
নদীর দুটি পাড়ে দেখা কখনও হয়না
নদীর বেগ কোন বাঁধা সয়না
গোধূলি আর সুপ্রভাতে অনেক অন্তর
তবুও তোমায় ভালোবাসি নিরন্তর
জানিনা কি ভাবে এই রোগ বাসা বেধেঁছে আমার শরীরে,শেষ কথা জানিয়ে গন্তব্যহীন যাত্রা শুরু করলাম।
ইতি
সুপ্রভাত
চিঠিটা শেষ করে মনে হলো আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। আমিও কি শুরু করেছি কোনো গন্তব্যহীন যাত্রা! বুকের ভেতর কি শুরু হলো বলতে পারবো না, শুধু মন আমার অস্ফুটে বলে উঠলো, "ভালোবাসি তোমায় সুপ্রভাত। তুমি ফিরে এসো, একটি ভুলের ক্ষমা কি পাবোনা আমি?"