Thursday, October 20

অজয় নন্দি


ষষ্ট ইন্দ্রিয় ( sixth sense )


 ষষ্ট ইন্দ্রিয় , যাকে ইংলিশ এ বলে সিক্সথ সেন্স , এটা নিয়ে অনেক ঘটনা শোনা যায়।  এমনি  একজনের কথা হটাৎ মনে পড়ে গেলো আজকে যার সিক্সথ সেন্স ছিল সাংঘাতিক । সুকৃত আমাদের সাথে  একই স্কুলে , একই ক্লাসে পড়তো। ওর অদভুত একটা গুণ ছিল যা আমাদের মাঝে মাঝে চমকে দিতো। তখন আমি স্কুল এ পড়ি ক্লাস নাইন এ , থাকতাম কলকাতায় মির্জাপুর এলাকায় । এক রবিবার সকালে আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে নিউ বারাকপুর গেছিলাম বেড়াতে। অনেক বছর আগের কথা , নিউ বারাকপুর তখন হল্ট স্টেশন , সব ট্রেন দাঁড়াতো না। এক বন্ধুর বাবা ওখানে বাগান বাড়ি করে ছিলেন। তখন জমির দাম খুব সস্তা ছিলো ওই দিকে , কারণ রাস্তা ঘাট ছিল কাঁচা , বিদ্যুৎ ও ছিল না। ওই বন্ধুর বাবার আলু পোস্তায় ভালো ব্যাবসা ছিল , আমাদের পাড়ার বড়লোক দের মধ্যে একজন , দূর্গা পুজোয় ওনাকে পুজো কমিটির প্রেসিডেন্ট করা হতো। 


ওনারই বড়ো ছেলে দুলু , ভালো নাম দুলাল আমাদের খুব কাছের বন্ধু ছিল।দুলু বেশ কয়েক বার আমাদের বলেছিলো , ওদের বাগান বাড়ি দেখতে যেতে। এক রবিবার ওর সাথে আমরা পাঁচ জন বেরিয়ে পড়লাম সকাল বেলায়।  ঝিরি ঝিরি  বৃষ্টি পড়ছিলো , আমরা শেয়ালদা স্টেশন থেকে বনগাঁ লাইন এর ট্রেন এ উঠে বসলাম। তখন ইলেকট্রিক ট্রেন চালু হয় নি , স্টিম ইঞ্জিন এর ট্রেন, সিটি বাজাতে বাজাতে এগিয়ে চললো , বেলা দশটা নাগাদ আমরা নিউ ব্যারাকপুরে পৌঁছে গেলাম। বৃষ্টি প্রায় থেমে গেছে , ট্রেন থেকে দু চার জন লোক নামলো আমাদের সাথে কিন্তু পাঁচ মিনিটের মধ্যে স্টেশন ফাঁকা হয়ে গেলো। আমরা সবাই নতুন সিগারেট খেতে শিখেছি তাই প্লাটফর্মে  ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা করে সিগারেট খেয়ে নিলাম। 

স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম জায়গাটা সম্পূর্ণ গ্রাম। কাঁচা রাস্তা ধরে আধ ঘন্টা চলার পর দুলাল দের বাগান বাড়ি পৌঁছে গেলাম। বিশাল জায়গা জুড়ে বাগান , গোটা তিনেক ঝিলের মতো বিশাল জলাশয় , কিন্তু বাড়ি  কোথাও দেখতে পেলাম না। জলাশয়ে ভর্তি আমেরিকান কৈ মাছ কিলবিল করছে। দুলালকে জিজ্ঞাসা করলাম , কিরে তোদের বাড়িটা কোন দিকে  ? দুলাল বললো , একটা ছোট টালির বাড়ি আছে সেখানেই ওদের এক জন চেনা লোক পরিবার নিয়ে বাস করেন। সেই পুরো জায়গাটা দেখা শুনো করেন। দূর থেকে একজন লুঙ্গি পরা খালি গায়ে , কাঁধে একটা গামছা , এগিয়ে এসে বললো , বাবুরা এসে গেছেন ? দুপুরে আপনাদের জন্য রান্না করতে বলে দি ? কি বলেন দুলাল দা ? বেশ বয়স্ক ভদ্রলোক দুলাল কে দাদা বলায় মনে মনে বেশ হেঁসে নিলাম। দুলাল ওনাকে বললো , ঠিক আছে শুধু মাংস ভাত খাবো , বলে পকেট থেকে কুড়ি টাকা বের করে দিলো ওনার হাতে। উনি তো কিছুতেই টাকাটা নেবেন না , যাই হোক শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলেন। বললেন আপনারা ঝিলে মাছ ধরুন , আমি আপনাদের ছিপ দিয়ে যাচ্ছি। গোটা তিনেক ছোট হাত ছিপ কোথা থেকে এনে আমাদের দিয়ে বললেন , আপনারা মাছ ধরুন আমি বাজার থেকে মাংস নিয়ে আসছি।যাওয়ার সময় বললেন , এখানে অনেক ফলের গাছ আছে বিশেষ করে পেয়ারা গাছ আপনারা পেড়ে খেতে পারেন। 

পাশেই জলার ধারে একটা বড়ো নারকোল  গাছের নিচে বাঁশের মাঁচা করা ছিল , তার নিচে বাঁশ দিয়ে বসার জায়গা , সেটা আমাদের দেখিয়ে বললো , আপনারা ওই জায়গায় বসে মাছ ধরুন। মাছ ধরে কি করে সুতো মাছের কানকোর মধ্যে ঢুকিয়ে জলের মধ্যে রাখতে হবে ,সেটাও আমাদের শিখিয়ে বিদায় নিলেন বাজার এর দিকে। আমরা চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। অনেক পেয়ারা গাছ চারিদিকে , এ ছাড়া নানা রকমের ফলের গাছ , সব খুব যত্ন করে লাগানো আছে। সবাই দু তিনটে করে পেয়ারা খেয়ে নারকোল গাছের নিচে  মাছ ধরতে বসে গেলাম। ঝিলের ভিতর মাছ ভর্তি , ছিপ ফেলার সঙ্গে সঙ্গে মাছ উঠতে থাকলো। আমাদের সবার আনন্দ ছিল দেখার মতো , একমাত্র সুকৃত কেমন যেন মনমরা হয়ে এক ধারে চুপ করে বসে ছিল। বারবার কেন জানি না আকাশ এর দিকে তাকাচ্ছে আর ওর মুখটা একটু একটু করে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। হটাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠলো এখান থেকে অন্য কোনো দিকে চল সবাই। একটু পরেই আকাশ জুড়ে কালো মেঘ ছেঁয়ে গেলো , শুরু হলো মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমক। হটাৎ সুকৃত খুব জোরে চেঁচিয়ে বললো , এক্ষুনি সবাই এখান থেকে অন্য দিকে চল, যদি প্রাণে বাঁচতে চাস, বলেই দৌড়াতে শুরু করলো। আমরাও ভালো করে কিছু না বুঝে ওর পিছন পিছন দৌড়াতে শুরু করলাম। কিছুটা দৌড়াবার পর দুলাল বললো ওই দেখ সামনেই আমাদের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে , বেশ জোরে জোরে বাজ পড়ছে  , আমরা দৌড়ে ওই বাড়িটার মধ্যে ঢুকে বারান্দায় উঠে দাঁড়ালাম। প্রায় ঘন্টা খানেক পর বৃষ্টি থামলো , যে ভদ্রলোক বাজারে গেছিলেন তিনি ছুটতে ছুটতে বাড়ির ভিতরে ঢুকে আমাদের দেখে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। তার পরেই ধপ করে বারান্দায় বসে পড়লেন , আমাদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন , যে নারকোল গাছটার নিচে আমরা বসে ছিলাম সেটার উপর বাজ পড়ে সম্পূর্ণ উপর টা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যে খড়ের ছাউনির নীচে আমরা বসে ছিলাম সেটাও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কাঁদো কাঁদো  মুখ করে বললেন আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় বেঁচে গেছেন। 

কথাটা শোনার পর আমরা সবাই ফ্যাল ফ্যাল করে সুকৃতের দিকে তাকালাম কিন্তু দেখলাম সুকৃত নির্বিকার ভাবে বসে আছে , যেন কিছুই হয়নি। সেদিন কোনো রকমে খাওয়া সেরে আমরা বাড়ির দিকে রওনা হলাম। ফেরার পথে দূর থেকে দেখলাম নারকোল গাছের মাথাটা পুরো পুড়ে কালো হয়ে আছে আর ঝিলের জলে অনেক মাছ মরে ভেসে উঠেছে। আমরা সবাই বারবার সুকৃতকে জিজ্ঞাসা করলাম , কেন ও  আমাদের ওই রকম দৌড়ে পালাতে  বললো। সেদিন ও আমাদের কিছুই বলেনি , বেশ কিছু বছর পর ঠিক একই  রকম একটা ঘটনা ঘটে। তখন আমরা জিজ্ঞাসা করায় সুকৃত বলেছিলো ওটা ওর সিক্সথ সেন্স যা নাকি মাঝে মাঝে কাজ করে। 

এরপর অনেক বছর কেটে গেছে , আমরা স্কুল থেকে কলেজ শেষ করে চাকরির জীবনে ঢুকে পড়েছি। কলেজে পড়ার সময় আমাদের প্রায়শই দেখা হতো কফি হাউসের আড্ডায় , কখনো আমরা একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যেতাম। আমরা কলকাতা থেকে বিরাটি চলে এলাম আর সুকৃত রা নতুন বাড়ি করে চলে গেলো মধ্যমগ্রাম। প্রায় রোজ অফিস যাওয়ার সময় দেখা হতো সুকৃত এর সাথে মধ্যমগ্রাম লোকালে, আর ফিরতাম দত্তপুকুর লোকালে একসঙ্গে। একদিন হটাৎ ঠিক হলো আমি আর দুলাল মধ্যমগ্রামে সুকৃত দের বাড়িতে রাত কাটাবো তার পরের দিন অফিস করে যে যার বাড়ি ফিরবো। যেহেতু তখন এতো ফোন ছিলোনা  তাই আমি আর দুলাল যে যার বাড়িতে লোক মারফৎ খবর পাঠিয়ে দিলাম যে পরের দিন অফিস করে বাড়ি ফিরবো। সুকৃত বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে , বাড়িতে ওর নিজস্ব একটা ঘর আছে , ঠিক হলো আমরা রাতে ওখানে চুটিয়ে আড্ডা মারবো। 

শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছাবার পর হটাৎ দেখলাম সুকৃত কেমন যেন উদাসীন হয়ে গেলো। কথাবার্তা হটাৎ থেমে গেলো , দত্তপুকুর লোকাল ও সিগন্যাল পেয়ে গেছে ছাড়বে বলে। গার্ড হর্ন বাজিয়ে দিয়েছে , আমরা দৌড়াচ্ছি ট্রেন ধরবো বোলে , হটাৎ সুকৃত চেঁচিয়ে উঠে বললো, কেউ পিছনে উঠবিনা , সামনের দিকে এগিয়ে চল। সুকৃত খুব জোরে দৌড়ে অনেকটা সামনের দিকে এগিয়ে একটা কম্পার্টমেন্টে উঠলো সঙ্গে আমি আর দুলালও উঠে পড়লাম। কামরাটা বেশ ফাঁকাই ছিল , আমরা বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। আমি সুকৃত কে জিজ্ঞাসা করলাম , এতটা দৌড় কৱালি কেন পিছনের দিকেই তো উঠতে পারতি। সুকৃত কোনো জবাব না দিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলো। 

ট্রেনটা উল্টোডাঙা পৌঁছে দাঁড়ালো , আমি সিগারেট বের  করে দুলাল কে দিলাম কিন্তু সুকৃত নিলো না। আমি সবে সিগারেট টা ধরিয়েছি ঠিক সেই সময় প্রচণ্ড একটা আওয়াজ করে ট্রেন টা ঝাকুনি দিয়ে খানিকটা  এগিয়ে থেমে গেলো। দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম পিছনের একটা কামরা আর একটার উপরে  উঠে গেছে , বেশ কিছু লোক আহত অবস্থায় চিৎকার করছে। একজন হকার বললো দার্জিলিং মেল আমাদের গাড়ির পিছনে ধাক্কা মেরেছে , পিছনের তিনটে কামরার বেশির ভাগ লোক মারাত্মক ভাবে আহত  হয়েছে। চারিদিক থেকে লোকজন ছুটে  এসে আহত দের কামরা থেকে বের করে প্লাটফর্মের উপর রাখতে থাকলো। কয়েক জনের আহত চেহারা দেখে আমাদের তো অবস্থা খারাপ , সুকৃত বললো চল আমরা ভি আই পি  রোড থেকে বাস ধরে চলে যাই , দেরি করলে আর বাসে ওঠা যাবেনা। এমনি আমাদের মানসিক অবস্থা যে কারো আর মাথা কাজ করছিলো না , কোনো রকমে স্টেশন থেকে বেরিয়ে উল্টোডাঙার মোড়ে পৌঁছে বাস ধরে মাধ্যমগ্রাম পৌছালাম। 

 মধ্যমগ্রামে পৌঁছে দেখলাম প্রতিটা গলির মুখে লোকজন জটলা করে একসিডেন্টের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছে। সুকৃতের বাড়ীর কাছে যেতেই দেখলাম , ওর বাবা মা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের দেখে নিশ্চিন্ত হলেন। ওনারা রেডিওর খবর থেকে জানতে পেরে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন , আমাদের মুখে সব শুনে বললেন, তোমরা  হাত মুখ ধুয়ে খাওয়া সেরে বিশ্রাম করো। দুলাল ও সুকৃত এর বাড়িতে ফোন ছিলো , দুলাল ওর বাড়িতে ফোন করে পৌছো সংবাদ জানিয়ে দিলো। আমি আমার পাড়ার এক ভদ্রলোকের বাড়িতে ফোন করে অনুরোধ করলাম , আমার বাড়িতে একটু খবর দিতে যে আমি নিরাপদে আছি কাল বাড়ী ফিরবো।ভদ্রলোক বললেন কোনো  চিন্তা করো না আমি এখুনি গিয়ে তোমার বাড়িতে জানিয়ে দেব।

অনেক রাত পর্যন্ত আমরা সেদিন ঘুমাতে পারিনি। একসময় আমি সুকৃত কে জিজ্ঞাসা করলাম , তোর কি করে মনে হলো যে ট্রেনটার পিছন দিকেই ওই রকম একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। সুকৃত সেদিন প্রথমবার আমাদের বললো , এইরকম ঘটনা নাকি মাঝে মাঝে ওর সাথে ঘটে। শুধু ওই বাগান বাড়ির ঘটনা এবং আজকের ট্রেনের ঘটনা দুটো ওর জীবনের সবথেকে বিশাল মাপের । বললো, কেনো জানিনা এই ধরনের কিছু হওয়ার আগে ওর মাথার মধ্যে কেমন একটা অস্বাভাবিক অনুভূতি তৈরী হয়।  তখন ও দেখতে পায় কি কি ঘটতে চলেছে। সুকৃত মনোবৈজ্ঞানিক এর কাছে গেছিলো , সুকৃতের কাছে সব শুনে তিনি বলেছেন এটাকে নাকি ষষ্ট ইন্দ্রিয় বলে।  খুব কম লোকের ভিতর এই ধরনের ক্ষমতা থাকে। পরের দিন সকাল  বেলায় আমরা যে যার বাড়ি ফিরে এলাম। এর পর  কয়েক বছর সুকৃতের সাথে রোজ ট্রেন এ দেখা হতো , ওই দুটো ঘটনা নিয়ে আর কোনো  দিন  কথা হয়নি। তারপর সুকৃত চাকরি সূত্রে বিদেশ চলে যাওয়ায় ওর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। 

No comments:

Post a Comment

লেখা পড়ুন এবং মতামত জানান ।