Saturday, December 24

সুপ্রিয়া দেবনাথ




নির্ভেজাল
      


তখন শ্যামবাজারের চৌমাথার মোড়ে আমরা দুজন প্রায় প্রতিদিনই পাপড়ি চাট খাই। আর সঙ্গে ছিল যৌবনের শুরুতে প্রথম প্রেম । টক মিষ্টি ঝাল সাধের সঙ্গে মিশে ছিল আমাদের অল্প বয়সের মিষ্টি ভালোবাসা। বেশ একটা অন্য সাধের অনুভূতি ছিল । পাপড়ি চাট তো না ! কি যে খেতাম! সে শুধু আমি আর ঈশ্বর জানেন। সে এক অনন্য সুখের সৃষ্টি। 
কিন্তু খাওয়া শেষে দীপশিখা বলে ,আজকের পাপড়ি চাট তেমন ভালো হয়নি । টক দই টা পুরনো ছিল । কিছু ভেজাল মেশানো আছে এর মধ্যে । আগের মতন আর অতো ভালো নেই ।ভেজাল শুরু হয়ে গেছে । 

এমন কথায় সে পাপড়ি  চাটের নানা মন্তব্য করতে করতে দুরে সরে যায়।  আমি পয়সা মিটিয়ে এসে বলি, কেন ভালইতো ছিল।
 ও বলতো চুপ কর তো ! বুঝিস  কিছু কোনটা ভালো কোনটা খারাপ!
 আমি চুপ করে থাকি।

নতুন প্রেমে  আমরা দুজনেই ডুবে ছিলাম তখন। আমাদের মধ্যে গভীর প্রেম।হলে কি  হবে  ,প্রেমের  ভিতরে বিশ্বাসের অভাব রয়েছে । আমরা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসি কিন্তু কেউ কাউকে বিশ্বাস করিনা । দীপশিখা আমার প্রতি অধিক পরিমাণ অবিশ্বাস করে থাকে ।ঠিক ঐ পাপড়ি চাটের মত ।রোজ রোজ পাপড়ি  চাট খায় আর রোজ নিন্দে বদনাম করে। আমার সঙ্গে সর্বদা তার মেলামেশা কিন্তু বিশ্বাস করে না একটুও। 

শুধু বলে, মেসেঞ্জার বন্ধ কর ।তোর  কতজন বন্ধু ?মেয়ে বন্ধু কতজন ?
এইরকম ।ওর সঙ্গে যখনই মিট করি ,আগে ফোনের যাবতীয় কিছু ডিলিট করে বেশ সতর্কের সঙ্গে আসি । কখন যে ফোন নিয়ে ঘাটতে ঘাটতে খুঁজে পাবে কোন দোষ তার ঠিক নেই । ঠিক একটি দোষ পেয়েও যায় কোন না কোনভাবে । তারপর চলতে থাকে নানা অশান্তি ।এই করতে করতে এক এক দিন সম্পর্ক প্রায় ভেঙে যাওয়ার দিকে হয়  । ওর নিজের ফোনেও যে ছেলেদের কম মেসেজ কমেন্ট রয়েছে তা কিন্তু নয় !তার টিকটকের ছবিতে 5  ,6 হাজার লাইক কমেন্ট রয়েছে, সব ছেলেদের করা কমেন্টস। এক একটা কমেন্টস পরলে গা পিত্তি জ্বলে যায় আমার, কিন্তু কিছু বলতে গেলে রাজ্যের অশান্তি । উল্টে আমাকেই তার টিক টকের জন্য মধু মাখানো কমেন্টস করতে হয় ।

বেশ কিছুদিন আগের কথা ,আমি তখন সিটি কলেজে, আর দীপশিখা গার্লস ভিক্টোরিয়াতে বোটানি নিয়ে পড়ছে ।আমি কলেজ ফেরত ওকে সঙ্গে করে নিয়ে একসাথে আমরা বাড়ি ফিরি । রোজ কত ঘন্টা যে ওই চলমান রাস্তার ধারে ভিক্টোরিয়ার সামনে একা দাঁড়িয়ে থাকি তা আর বলে শেষ করতে পারবো না । গেটের দিকে তাকিয়েই থাকি কখন বেরোবে সে। তার আর বেরোনোর সময় হয়না ।এদিকে সন্ধ্যে পাঁচটা বেজে যায় । তারপর যখন আসবে, হন্তদন্ত হয়ে এসে বলবে একটা প্রাকটিক্যাল করতে গিয়ে খুব দেরি হয়ে গেল । তারপর ভারী ব্যাগটা আমার কাধে ঝুলিয়ে দিয়ে আরো হাতের কি কি সব কাগজপত্র গুছাতে থাকে । আর মুখে নানা রকম গাছের বৈজ্ঞানিক নামের কথা বলা শুরু করে । আমি চুপ করে থাকি ।দেখতে থাকি তাকে।

 তারপর দুজনে হাঁটতে থাকি শিয়ালদা স্টেশনের দিকে। চলার পথে যদি কোন নতুন ধরনের অর্থাৎ দীপশিখার অপরিচিত কোন গাছ চোখে পড়ে যায় গাছ বিক্রেতাদের কাছে তাহলে আরো দুই ঘন্টা সময় আমার গেল । কি যে তার প্রশ্ন কথা আর কত যে দেখার বাকি থাকে তা দেখে আমার ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে যায়। নিজের চোখে না দেখলে বোঝানো মুশকিল । যদি পছন্দ হয়ে যায় কোন গাছ তাহলে আর এক বিপত্তি ঘটে। সে গাছ কিনে ধরিয়ে দিল আমার হাতে । নাও বোঝা বয়ে চলো এবার ! হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বলার সময় টুকু আমি পাই না ।

 দীপশিখা একদিন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো। এসেই বলে বড্ড খিদে পেয়ে গেছে। আজ টিফিন আনিনি ।ক্যান্টিনে যাওয়ার সময় পাইনি । আগে একটা কিছু খাই চল। চাওমিন খাবো আজ। হাটতে থাকি আমরা রেস্টুরেন্টের  দিকে । এসেও গেলাম আমরা। ভিতরে ঢুকে দুজনে চাওমিনের অর্ডার করে চেয়ার টেবিলে বসলাম । বসেই দীপশিখা আমার হাতের মোবাইল ছিনিয়ে নিল । আমিও তার টা নিলাম । আমাদের ফোন হাত বদল হলো । দুজনে খুঁজে চলেছি দুজনের দোষ ত্রুটি । আমি মনে মনে জানি আমার মোবাইলে কিছুই নেই ।আমি সব ডিলিট করে এসেছি আগে থেকেই । 
আমি দেখছি ওর মেসেঞ্জার । হ্যাঁ পেলাম তার ছেলে বন্ধুদের ।প্রীতম ,অনুরাগ ,অঙ্কুশ আরো আরো অনেকে। 

প্রীতমের মেসেজ, ফিরতে দেরী হবে রাত আটটা বাজবে ।

অনুরাগের, অত রাত করো না ,শুয়ে পড়ো ।
অঙ্কুশের ,শুভ রাত্রি ।

ম্যাসেজ গুলো পড়ে আমি বলি ,এসব কি? এত কথা হয় তোমার সাথে এদের! 

দীপশিখা বলে ,আমি তো আর মিথ্যা কথা বলি না ,তাই ডিলিট করে আসিনি। কোনো সৎ সাহস নেই না তোমার? ওরা আমার বন্ধু । তোমার মোবাইল তো একেবারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । জালিক একটা । আজকালকার খাদ্য খাবারের মত দিনকে দিন ভেজাল হয়ে পড়ছো। তোমার  একটি মাত্র মেয়ে বন্ধু রয়েছে, তাই না? যার নাম সাবিত্রী। আমাকে সে কথা বিশ্বাস করতে হবে । সে কিনা রাধা কৃষ্ণের ছবি দিয়ে গুড মর্নিং জানায় তোমাকে। কথাটি শেষ করেই ছুড়ে মারল মোবাইলটি আমার দিকে । 

চাওমিনের প্লেট এল । আমরা দুজন খাচ্ছি ।আমার আবার খুব বেঁছে খাওয়ার অভ্যেস ।চাওমিন থেকে গাজর ,শসা কিছু জমে থাকা চাও বাদ দিয়ে খাচ্ছি । খাওয়া শেষে আমার অনেকটা বাঁছাই চাউমিন বাদ পরে গেল । 
দীপশিখা বলে, অতো ফেলেছো কেন ?এরকম করে কেউ খায় নাকি? দাও প্লেট আমার দিকে।  সে আমার প্লেট নিয়ে আমার ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট টুকু সুন্দরভাবে গুছিয়ে খেতে থাকলো আর অনর্গল তার প্রফেসর কি গাছের সম্পর্কে কি বুঝিয়েছে তা বলতে থাকলো। আমি তার একটি কথাও শুনছিলাম না ।আমি দেখছি কত ভালোবাসা থাকলে নির্দ্বিধায় নিঃসংকোচে এই খাদ্য গ্রহণ করা যায় ।ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি। ঠিক এমনি করে তাকিয়ে থাকি আমরা একটি কোল্ড্রিংসের বোতলে দুটো স্ট্র ডুবিয়ে দুজনে দুজনের চোখের দিকে। ভালোবাসাকে বিশ্বাসের আসনে বসিয়ে সেদিন রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে এসেছিলাম ।

বেশ চলছিল আমাদের দিন । হঠাৎ করে  শুরু হচ্ছিল জীবনের  পরিবর্তন। আমি চাকরী পেয়ে ব্যাঙ্গালোরে চলে গেলাম ।দীপশিখা এমএসসি কমপ্লিট করে পিএইচডি করছে ।সম্পর্কটা ঠিক ঠাক আছে ।

প্রায় এক বছর পর আমি কলকাতায় ফিরেছি । আমি আসবো দীপশিখা জানে। কবে ঢুকব কলকাতায় সে খবরটা জানতো না । সারপ্রাইজ দেব ভেবে কথাটা চেপেই গিয়েছিলাম। 

সেদিন বেলা একটা বাজে তখন। বৈশাখ মাসের প্রখর রোদ । আমি এক বিশেষ প্রয়োজনে ছাতা হাতে শ্যামবাজারের চৌমাথার মোড়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছি ।হঠাৎ দেখি দূরে এক ডাব বিক্রেতার সামনে দাঁড়িয়ে দীপশিখা । তার পাশে আরেক জন  দাঁড়িয়ে । যাকে আমি এর আগে আরো দুবার দেখেছিলাম । তার নাম প্রীতম । তার হাতে একটি কাটা ডাবের মুখে দুটি স্ট্র ডুবানো । দীপশিখা  উছলে পড়া হাসি আর খুশি তে একটি স্ট্র মুখে  দুই ঠোঁটের চাপে ডাবের জল পানে ব্যস্ত । আর একটা  স্ট্র প্রীতমের মুখে। আমি ঠিক দেখছি কিনা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । দীপশিখার গায়ের টপ টি কেনার সময় আমি তার সঙ্গে ছিলাম । সিটি মার্কেট থেকে আমি পছন্দ করে দিয়েছি। আমার সন্দেহ কাটতে দুই মিনিট সময় লাগলো । তারপর যা ঘটলো, সব কিছুর উল্টো অনুভূতি হতে থাকলো আমার ।গ্রীষ্মের প্রখর রোদ তাপ ঠান্ডা বরফ মনে হতে থাকলো। চলমান যানবাহন সমস্ত কিছুর গতিবিধি যেন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পরল । ঝরঝরে রৌদ্র আলো কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেল সারা দুনিয়া। থেমে গেল আমার জীবনের গতি। নিভে গেল দীপশিখা। 
অবিশ্বাসের আস্থা থেকে নিজের চৈতন্য বোধ হারিয়ে ফেলেছিলাম । যখন ফিরে পেলাম নিজের সত্তঃ তখন দেখি তেষ্টায় আমার গলা শুকিয়ে কাঠ । সামনে একটা কোল্ড্রিংসের দোকান ছিল। ভাবলাম একটা কোলড্রিংস পান করি । এগিয়ে গেলাম কোল্ড্রিংসের দোকানে। একটা বোতল হাতে নিলাম । হঠাৎ করে কোনো এক স্মৃতিকথা মনের গভীরে আলোকিত হয়ে উঁকি দিল । এতদিনের জমানো অনেক স্মৃতির একটা মিষ্টি মধুর স্মৃতির কথা । যে স্মৃতি ঘন্টাখানেক আগেও মিষ্টি ছিল ।  কখন জানি সে স্মৃতির উপর বিষ বিষাক্ত তিক্ততায় ছেয়ে গেল মন। ড্রিকংসের বোতল রেখে বেরিয়ে এলাম বাইরে । হাঁটতে থাকি বাড়ির দিকে ।হঠাৎ পেছন থেকে শুনতে পেলাম ,দীপশিখার কন্ঠস্বর । সে ডাকতে থাকলো সৈকত দাঁড়াও ,দাঁড়াও সৈকত ।
পেছনে ফিরে চেয়ে দেখার রুচি আমার আর ছিল না । মনে হয়েছিল মিথ্যা ভেজাল এই ভালোবাসা । আমি এই ভেজাল শব্দটি কোনদিনও কোন কারণে কখনো বলিনি । দীপশিখার মুখে শুনেছিলাম কয়েকবার । এই শব্দটির সাথে আজ পরিচয় ঘটলো নিজের জীবনের সঙ্গে ।  প্রেম ভালোবাসার ভিতরে এতটা ভেজাল আর মিথ্যা ছিল ,আর এমন ভেজাল হতে পারে তা কিছুতেই নিজের মনে মেনে নিতে পারছিলাম না ।
বাড়ি ফিরে এলাম ।আমার অবসন্ন মুখ দেখে মা দোষারোপ করলেন গ্রীস্মের রৌদ্র তাপকে। 

 তিনি লেবু চিনির শরবত আমার সামনে এনে ধরলেন ।  মায়ের হাতের শরবত পান  করলাম একেবারে নির্ভেজাল। শরীর মন দুই-ই শীতল শান্তি হলো আমার ।

No comments:

Post a Comment

লেখা পড়ুন এবং মতামত জানান ।