Sunday, November 20

আকবর হোসেন


জীবন বেদের নানা অধ্যায়

 

আমাদের জীবনের সবচেয়ে উত্তম গল্প আমাদের আপন জীবনের কথা। সেই জন্যই আমি যখন লিখি অনেক পাঠক আবেগে আপ্লূত হয়ে বলেন, আপনি আমায় কাঁদালেন। আমাদের অনুভূতি যখন অশ্রুজলে বিগলিত হয়ে বের হয়ে আসে আমাদের প্রাণের কথার বিস্তার জগতের বহমান অদেখা

স্রোতে মিশে যায়। ক্ষতি আর ক্ষত সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আজ এমনি একটি স্মৃতির কথা লিখতে বসেছি।

আমার ছেলেবেলায় আমাদের গ্রামে হিন্দু মুসলমান সবাই মিলেমিশে বসবাস করতো আর ধর্ম নিয়ে কোন সংঘাত ছিলনা। আমাদের পাশের বাড়িতে বিসম্ভর ডাক্তার থাকতেন। তাঁর স্ত্রী নিমাই সন্ন্যাসীর জন্য করুণ সুরে গান গাইতেন সে কথা এখনো আমার পরিষ্কার মনে আছে। পরে তারা সব ধীরে ধীরে বাড়িঘর জমিজামা বিক্রি করে নীরবে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলেন। তখন মসজিদে আজান আর পাশের হিন্দু বাড়িতে সন্ধ্যা পূজার ঘণ্টায় কোন বিবাদও ছিল না। ললিত মোহন কাকা আমাদের গ্রামের জন্ম মৃত্যুর হিসেব রাখতেন। বিরাট লম্বা স্বাস্থ্যবান পুরুষ ছিলেন। খালি পায়েই থাকতেন সাধারণত আর যখন তখন যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁর কাজ ছিলো কোথায় কার ঘরে জন্ম আর মৃত্যু হোল তা লিখে রাখা। এর জন্য কেউ তাঁকে কিছু দিতো এমন নয়। আমি তখন স্কুলে পড়ি একদিন এসে আমাকে বললেনদ্যাখ আমি যখন থাকবোনা এ কাজটি তুই করবি। আমি যেদিন মরে যাব সেই দিন ক্ষণটি ঠিকমতো লিখে রাখবি।

হলে ন্যাকড়ায় পেচানো শিশুটিকে কোলে নিয়ে আদর করে তার জন্মের দিন ক্ষণ নাম সযত্নে একটি মোটা বাঁধানো খাতায় উঠিয়ে রাখতেন। আর কেউ মরে গেলে মাথা নিচু করে শবযাত্রায় সাথী হতেন তার পর ঘরে বসে নীরবে দিন ক্ষণটি লিখতেন। আমাদের গ্রামের খেত মজুর রশিদের সাত দিনের বাচ্চাটা মারা গেলে আমি সে সংবাদটি ললিত কাকাকে দিতে গেলাম। তিনি ঝর ঝর করে কেঁদে বললেনএটা তুই লেখ আমি পারবো না।,

 

একদিন আমাকে প্রশ্ন করলেনতুই তো ছেলেমানুষ কিন্ত কখনো জন্ম মৃত্যু নিয়ে ভেবেছিস?, বললামকি জানি মানুষ জন্মে আর মরে তাতো জানি।ললিত কাকা বললেনদেখ জন্ম মৃত্যু সহজ কথা নয় কিন্ত। একটা মানুষ থেকে আরেকটা মানুষের জন্মতার বেঁচে থাকাবড় হওয়াতারপর একদিন মরে যাওয়া একটা মস্তবড় রহস্য। এক একটা মানুষ এক একটা আলাদা ইতিহাস। আর আমি যে এদের জন্ম মৃত্যুর দিন ক্ষণ লিখে রাখি এ যেন তাদের ইতিহাসকে দুছত্রে বন্দী করে রাখা।, এরা সব চলে যায় আর পেছনে ফেলে যায় ইতিহাস। কোটি কোটি বছর ধরে মানুষ মরছে আর ইতিহাসে পাতা যোগ হচ্ছে।

 একদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এসে আমাকে বললেনওহ আজকে একজনের মৃত্যুর তারিখটা লিখতে হবে।বললাম আজ তো আমাদের গ্রামে কেউ মারা যায়নি?, না রে তা নয়কাচারিতে সাক্ষী দিতে উঠে কিছু না বলেই একটা লোক মরে গেল। কি ছিল তার মনে কি জানি প্রকাশের বেদনাটুকু বুঝি তার আর সইলো না। তার আগেই ধুপ করে পড়ে মরে গেল। তাকে আমি জানি তো না কিন্ত তার বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার রহস্যটা ভাবলাম আমার খাতায় লিখে রাখি।এখানে আমার হরিহর মাঝির কথাটাও একটু বলে রাখি। সিলেট মাধবপুর বাজারের কোল ঘেসে একটি শীর্ণকায়া নদী আছে। সেকালে তার উপর কোন সেতু ছিল না। একটি খেয়া নৌকা দূরদূরান্তের যাত্রীদের পারাপার করতো। আর সেই খেয়ার মাঝি ছিল হরিহর। সে বড় ভালোমানুষ ছিল আর আমার প্রতি তার স্নেহ ছিল খুব গভীর। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি একদিন তাকে খেয়া পারাপারে না দেখে একটু দূরেই তার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিলাম। জানা গেল হরিহর আর বেঁচে নেই। তার স্ত্রী জানালেন মেয়েকে বিয়ে দিয়ে হরিহর তারই খেয়ায় বসিয়ে মেয়ে আর মেয়ে জামাইকে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দিতে গিয়েছিল। অনেক রাত হলেও হরিহর ফিরে এলোনা দেখে গ্রামের মানুষেরা নৌকা নিয়ে তার খোঁজে বের হোল। সেদিন পূর্ণিমার রাত ছিল। তাকে পাওয়া গিয়েছিল তারই ভাসমান নৌকায় মৃত অবস্থায়। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম সারাজীবন যে কতশত মানুষকে পারাপার করে দিয়েছিল তার এই একটি পারাপারের বেদনা সইলো না!

তারপর অনেকদিন চলে গেলো। একবার গ্রামে গিয়ে জানলাম ললিত কাকা আর বেঁচে নেই। তাঁর বিধবা স্ত্রীর কাছ থেকে খাতাটি চেয়ে নিয়ে দেখলাম তাঁর মৃত্যুর দিন ক্ষণ কেউ সেখানে উঠায়নি। সেটি উঠাতে গিয়ে মনে মনে বললামললিত কাকা তুমি আমায় এমন ভারী কাজটি দিয়ে গেলে?

 

ললিত মোহন কাকা সারা জীবন জন্ম মৃত্যুর হিসাব রেখে কার অদেখা হিসাবে জীবন মরণের ওপারে নিজেকে মেলালেন কি জানি!

No comments:

Post a Comment

লেখা পড়ুন এবং মতামত জানান ।