Sunday, October 16

বিশ্বজিৎ চৌধুরী রিবর্ন (বাংলাদেশ )



  সুনীল স্যার

              
উত্তেজনায় ছটফট করছিল রেদোয়ান। মাঘ মাসের প্রথম সন্ধ্যায় প্রকৃতি তখন জবুথবু  হয়ে সন্ধান করছে উষ্ণতার। অথচ, রেদোয়ানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চিৎকার করে সে সাবিহাকে বললো, পানি দাও!

গায়ে পশমি কম্বল জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল সাবিহা। রেদোয়ানের চিৎকারে তার শরীরের বাকি অংশ নির্লিপ্ত থাকলেও, কুঞ্চিত হল ভ্রম্নজোড়া। সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো রেদোয়ানের দিকে। রেদোয়ানের কপালে থাকা ঘামের বিন্দুগুলোর আকার ক্রমশ বড় হতে লাগলো। সে নিজেই টি—টেবিলের ওপরে থাকা জগ মুখের ওপরে ধরে ঢকঢক করে পানি গিলতে লাগলো।

রেদোয়ানের এ দুর্দশার কারণ— সুনীল স্যার। বেডরুমে রেদোয়ান যখন কাঁপছিল, ঠিক সে সময় ড্রয়িংরুমে রেদোয়ান ও সাবিহার একমাত্র ছেলে ক্লাস সেভেনে পড়া দীপুকে অঙ্ক করাচ্ছিলেন সুনীল স্যার।
সুনীল স্যারকে দেখে রেদোয়ানের এমন কাঁপাকাঁপি আজ নতুন নয়। চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথ মডেল পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে যেদিন সুনীল স্যার প্রথম গণিতের ক্লাস নিতে এসেছিলেন, স্যারকে দেখে রেদোয়ানের কাঁপাকাঁপি শুরু হয়েছিল ঠিক সেদিন থেকে। ক্লাসের প্রায় সকল ছাত্রের অবস্থা ছিল রেদোয়ানের মতোই। অথচ, অঙ্ক করতে ভুল করলে অথবা দুষ্টুমি করলে, সুনীল স্যার কাউকে বেত্রাঘাত বা চপেটাঘাত করেছেন, এমনটা কেউ বলতে পারে না। রেগে গেলে সুনীল স্যার দুটি কাজ করতেন। এক. যার প্রতি তিনি রুষ্ট হয়েছেন, তার দিকে বড় বড় চোখে একভাবে তাকিয়ে থাকতেন। দুই. মিনিট খানেক পরে থমথমে গলায় বলতেন, বসো। অথচ, এটুকুতেই ছাত্র—ছাত্রীদের কোমায় চলে যাওয়ার মতো অবস্থা হতো।

তবে সুনীল স্যারের অঙ্ক করানোর ধরণ ছিল অসাধারণ। অঙ্কের সূত্রগুলো বুঝিয়ে দিতেন তার নিজের তৈরি করা গল্পের সাহায্যে। মজার মজার সেই গল্পগুলো ছাত্ররা আগ্রহভরে শুনতো। গল্পগুলো শুনতে শুনতে বীজগণিতের কঠিন সূত্রগুলো কীভাবে যে মুখস্থ হয়ে যেত, ছাত্ররা নিজেরাও টের পেত না। রেদোয়ানের এখনও মনে আছে সুনীল স্যারের ভাল্লুক ও চিনেবাদামওয়ালার গল্প। সেই গল্পের মাধ্যমে তিনি রেদোয়ানদের এ প্লাস বি হোল স্কয়ারের সূত্র শিখিয়েছিলেন।

গণিত বইয়ের সকল পাতা ছিল সুনীল স্যারের মুখস্থ। কেউ যদি স্যারের দিকে বই এগিয়ে দিয়ে বলতো, স্যার, এই অঙ্কটি বুঝতে পারছি না, স্যার বই হাতে না নিয়ে চোখ বন্ধ করে তাকে জিজ্ঞাসা করতেন, কোন অনুশীলনীর কত নম্বর অঙ্ক?
অনুশীলনী ও অঙ্ক নম্বর শোনার পরে সুনীল স্যার চোখ বন্ধ করেই মুখে মুখে অঙ্কটি বুঝিয়ে দিতেন।

যে বছর রেদোয়ান এসএসসি পাশ করেছিল, ঠিক সে বছরেই রেদোয়ানের বাবা চাটমোহরের বাড়ি বিক্রি করে দেন। সপরিবারে তারা চলে আসেন পাবনায়। ফলে সুনীল স্যারের সাথে রেদোয়ানের দীর্ঘদিন দেখা হয়নি। এক সপ্তাহ আগে টোকিও হোমিও হলের সামনে সুনীল স্যারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আনন্দে রেদোয়ানের চোখে পানি চলে এসেছিল। রেদোয়ানের এত আনন্দিত হওয়ার কারণ ছিল দুটি।

এক. দীর্ঘদিন পরে প্রিয় শিক্ষাগুরুর সাথে সাক্ষাৎ অবশ্যই রেদোয়ানের জন্য ছিল একটি বড় ব্যাপার। দুই. দীপুকে নিয়ে মনে জমে থাকা দুশ্চিন্তার অবসান। দীপু গণিতে খুব কাঁচা। ক্লাস সিক্সে যদিওবা সে গণিতে কোনোক্রমে উতরে গেছে, ক্লাস সেভেনে তার অবস্থা হয়েছে শোচনীয়। ভীতির কারণে এখন সে গণিত বই হাতেই নিতে চায় না। শহরের একজন নামকরা গণিতের শিক্ষকের কাছে দীপু অঙ্ক শিখছে। কিন্তু সেই স্যার প্রতি ব্যাচে নূন্যতম চল্লিশ জন করে ছাত্র পড়ান। অত ছাত্রের মাঝে দীপুর পক্ষে ভালো করে অঙ্ক বোঝা সম্ভব হয়ে উঠছে না। কয়েকজন নামকরা গৃহশিক্ষকের সাথে রেদোয়ানের যোগাযোগ হয়েছিল। তাদের গগনচুম্বি পারিশ্রমিক পরিশোধ করতে রেদোয়ান রাজি থাকলেও, তাদের নাকি সকাল ছয়টা থেকে রাত্রি এগারোটার মধ্যে ফাঁকা সময় নাই। এমতাবস্থায় টোকিও হোমিও হলের সামনে সুনীল স্যারকে দেখে রেদোয়ানের মনে হয়েছিল, দীপুকে পড়ানোর জন্য স্যারকে যদি কোনোমতে রাজি করানো যায়, তবে দীপুর গণিত—ভীতি দূর হয়ে যাবে এক নিমিষে।

সুনীল স্যারকে রাজি করাতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি রেদোয়ানের। রেদোয়ানের অনুরোধে সুনীল স্যারের অনতিবিলম্বে সাড়া দেওয়ার কারণ— স্যারের বর্তমান আর্থিক অবস্থা। সুনীল স্যারের একমাত্র ছেলে সুধাংশুর পাবনা শহরে একটি নামকরা রেস্টুরেন্ট ছিল। রিটায়ারমেন্টের পরে সুনীল স্যার চাটমোহরের বাড়ি বিক্রি করে পাবনা শহরে ছেলের বাড়িতে একেবারে চলে আসেন। বছর তিনেক আগে সুধাংশু হঠাৎ করেই মদ, জুয়া ও পরনারীতে আসক্ত হয়ে পরে। তার ব্যবসা লাটে ওঠে। সে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ে। কয়েক মাসের মধ্যে সুধাংশু সুনীল স্যারের জমানো সব টাকা হাওয়া করে দেয়। এখন সে জেলে আছে। মাস ছয়েক আগে সুনীল স্যার হৃদরোগে আক্রান্ত হন। আত্মীয়—স্বজন, পরিচিত ব্যক্তি ও ছাত্রদের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নিয়ে তিনি ওপেন হার্ট সার্জারি করান। বর্তমানে তার অবস্থা শোচনীয়। দুবেলার আহার তার প্রতিদিন জোটে না।
সেদিন সুনীল স্যারকে বাড়িতে এনে ড্রয়িংরুমে তাকে বসিয়ে সাবিহার কাছে এসে রেদোয়ান তাকে উত্তেজিত কণ্ঠে বলেছিল, সাবিহা, এসএসসি পর্যন্ত দীপুর গণিত নিয়ে আর কোনো চিন্তা নাই। সুনীল স্যার দীপুকে গণিত পড়াতে রাজি হয়েছেন।
রেদোয়ানের এ আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
সুনীল স্যার দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত। তিনি এখন চোখে খুব ভালো দেখতে পান না; কানে শুনতে পান খুব কষ্ট করে। তাছাড়া বর্তমানের সৃজনশীল পদ্ধতির সাথেও তিনি অপরিচিত। ফলে গত এক সপ্তাহে সুনীল স্যার শুধু আসা যাওয়াই করেছেন; দীপুর গণিত—ভীতি দূর করতে পারেননি একটুকুও।  

ড্রয়িংরুমের কাছে এসে উঁকি দিল রেদোয়ান। দেখলো, সুনীল স্যার গণিত বই হাতে নিয়ে কী যেন জোরে জোরে পড়ছেন। অন্যদিকে দীপু আপন মনে তার মায়ের মোবাইল ফোন টেপাটিপি করছে। ড্রয়িংরুমের ভেতরে এক পা বাড়িয়ে সাথে সাথে কয়েক পা পিছিয়ে এল সে। তার খুব ইচ্ছা হলো, সে সাবিহাকে বলবে, আর কয়েকটা দিন দেখবে কি?

কিন্তু সাবিহা খুব জেদি মেয়ে। প্রথম দিন সুনীল স্যার দীপুকে পড়িয়ে চলে যাওয়ার পরপরই সাবিহা রেদোয়ানকে বলেছিল, এ কোন ঘাটের মড়াকে এনে বাড়িতে জোটালে তুমি? চোখে দেখে না; কানে শোনে না; কী বলেন শুধু নিজেই বোঝেন! কাল থেকে যেন উনি এ বাড়িতে আর না আসেন।
সেদিন রেদোয়ান তাকে অনেক অনুরোধ করে বলেছিল, প্লিজ, স্যারকে অন্তত এক সপ্তাহ আসতে দাও।

এক সপ্তাহ কেটে গেছে। এই এক সপ্তাহে দীপুর গণিত শিক্ষারও কোনো উন্নতি হয়নি, সাবিহার ক্রোধেরও কোনো অবনতি ঘটেনি। তবে দিন যত যাচ্ছে, রেদোয়ানের ছটফটানির মাত্রা বাড়ছে তত বেশি।
রেদোয়ান লম্বা করে শ্বাস নিল। বুকে সাহস সঞ্চয় করে সে পৌঁছে গেল সুনীল স্যারের কাছে। উত্তেজিত কণ্ঠে সে স্যারকে বললো, স্যার, আদাব।

রেদোয়ানের কথা শুনে মোবাইল ফোন থেকে মুখ ঘুরিয়ে দীপু তার বাবার মুখের দিকে তাকালো, কিন্তু সুনীল স্যারের কোনো ভাবান্তর হলো না। তিনি রেদোয়ানের কথা শুনতে পাননি।

কণ্ঠস্বর একটু উচ্চ করলো রেদোয়ান। বললো, আদাব, স্যার।

এবার সুনীল স্যার রেদোয়ানের মুখের দিকে তাকালেন।

রেদোয়ান সাবিহার শেখানো কথা একটানা বলা শুরু করলো। সে বললো, স্যার, একটি সুসংবাদ আছে। আমার প্রমোশন হয়েছে। আমাকে ঢাকায় বদলি করা হয়েছে। কাল সকালেই আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবো। স্যার, ঢাকায় কি আপনার পরিচিত কোনো শিক্ষক আছেন, যিনি ঠিক আপনার মতোই দীপুকে অঙ্ক শেখাতে পারবেন?
সুনীল স্যার অবাক হয়ে রেদোয়ানের দিকে তাকালেন। একটু পরে মাথা নাড়িয়ে বললেন, না তো, এমন কোনো পরিচিত শিক্ষক নেই।

রেদোয়ান বললো, তাহলে স্যার, দীপুকে এমন কিছু টিপ্স দিন, যাতে ঢাকায় গিয়ে গণিতে ওর তেমন কোনো সমস্যা না হয়। আর এই নিন, স্যার, আপনার এই মাসের টাকা।

রেদোয়ান সুনীল স্যারের হাতে একটি খাম দিল। খামের ভেতরে ছিল তিনটি এক হাজার টাকার নোট। রেদোয়ানের হাত থেকে খামটি নিয়ে সুনীল স্যার সেটি তার পাঞ্জাবির পকেটে রাখলেন।

হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো রেদোয়ান। বেডরুমে এসে মুচকি হেসে সাবিহাকে সে বললো, সাবিহা, কাজ হয়ে গেছে।

আটটা পাঁচে সুনীল স্যারের পড়ানো শেষ হলো। দীপু এসে তার বাবাকে বললো, আব্বু, স্যার এখন চলে যাবেন।

ফ্ল্যাটের বাইরে যাওয়ার জন্য দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুনীল স্যার। রেদোয়ানকে আসতে দেখে তিনি হেসে বললেন, টাকাটা পেয়ে বেশ ভালোই হলো রেদোয়ান। অনেক দিন মাগুর মাছ খাওয়া হয়নি। ভাবছি, কাল দেশি মাগুরের ঝোল দিয়ে গরম ভাত খাবো।

স্যারের মুখে হাসি দেখে রেদোয়ানের খুব ভালো লাগলো। স্যারের দিকে তাকিয়ে সে বললো, স্যার, আমাদের জন্য দোয়া করবেন।

রেদোয়ান দরজা খুলে দিলে সুনীল স্যার দরজার বাইরে পা বাড়ালেন। সিঁড়িঘরের কাছে এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এলেন। বললেন, রেদোয়ান, একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো তোমাকে। দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি তো অনেকটাই কমে গেছে; স্মৃতিশক্তিটা ঠিক আছে কিনা তা জানার জন্যই প্রশ্নটা করবো।

উৎসুক দৃষ্টিতে স্যারের দিকে তাকিয়ে রেদোয়ান বললো, জ্বি স্যার, বলুন।
সুনীল স্যার বললেন, আচ্ছা রেদোয়ান, টোকিও হোমিও হলের সামনে যেদিন তোমার সাথে দেখা হলো, সেদিন কি তুমি আমাকে বলোনি যে, তুমি ইলেক্ট্রনিক্সের ব্যবসা করো?

কেঁপে উঠলো রেদোয়ানের হৃদপিণ্ড। সেদিন সুনীল স্যার দীপুকে গণিত শেখাতে রাজি হওয়ায় রেদোয়ান এতটাই অভিভূত হয়ে গিয়েছিল যে, সেদিন স্যারকে যে সে তার পেশার কথা বলেছিল, তা আর তার খেয়ালই ছিল না।

মাথা নিচু করে রেদোয়ান জবাব দিল, জ্বি স্যার, আপনি ঠিকই শুনেছিলেন। সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজের কাছে আমার ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান আছে।
সুনীল স্যার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে রেদোয়ানের দেয়া খামটি বের করে সুনীল স্যার বললেন, আমি জানি, রেদোয়ান, এ টাকা আমার প্রাপ্য নয়। কিন্তু বাবা, পেটে যখন ক্ষুধা থাকে, নৈতিকতাকে তখন সবচেয়ে বড় শত্রু মনে হয়।

সুনীল স্যার খামটি আবার তার পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুনীল স্যার বললেন, আচ্ছা, রেদোয়ান, তুমি কি আমাকে একটি ওয়ান বা টুয়ের ছাত্র জোগাড় করে দিতে পারবে? সব বিষয় পড়াবো। টাকা কিছু কম দিলেও চলবে। ওয়ান বা টুয়ের ছাত্র আমি বেশ ভালোই পড়াতে পারবো।

রেদোয়ান ফ্যালফ্যাল করে সুনীল স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। রেদোয়ান দেখলো, চাটমোহরের সেই সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু একটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায় তার প্রাক্তন শিষ্যের মুখের দিকে ভিখারির মতো কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ করে রেদোয়ানের বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। স্যারের প্রশ্নের জবাবে সে মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের করতে পারলো না।
দু—চোখ দিয়ে যখন অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পরে, তখন কি কোনো প্রশ্নের জবাব দেয়া যায়?

দুলাল কাটারী

তবুও,মনে মনে কত্ত ফাঁকি!
             

সকল'ই পুলকে মেঘের পালকে রূপের আলোকে
 ওহে সখা মোর!
জীবন নদীর তীরে কবে যে ধীরে ধীরে এলো
 শুধু তুমি তুমি স্বর।

তোমার'ই অনুভবে শয়নে স্বপনে সবে 
গানে গানে শুধু ডাকি,
আমার ভুবন হয়ে হৃদমাঝারে রয়ে
 তবুও, মনে মনে কত্ত  ফাঁকি!
 
কেন তবে মিছে মায়া হরিণীর পিছে 
ধেয়ে ধেয়ে ঘোরে প্রাণ,
পশ্চিম আকাশে হিমেল বাতাসে ভাসে 
বেলা শেষের'ই গান।
 
যে হয় প্রেমে মাতাল কে ধরে তার হাল 
বলো হে দয়াল!
গড়াগড়ি যাই হাবুডুবু খাই বাঁচি কী মরি 
সব তোমার'ই খেয়াল!

পাষাণ মনের দ্বারে করাঘাত বারেবার।
 একটি বারের তরে তাকিয়ে প্রেমদৃষ্টে 
বক্ষে জড়িয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে,
করো কৃপা,শোনো অনুরোধ তার।



অরুণ কুমার মহাপাত্র


আত্ম নিবেদন


কমলা এখনো ঘুমে অচেতন...
ঘরের ভেতর ঘন ঘন নিশ্বাসে ওঠানামা
করে আমার ভবিষ্যৎ...
চাতক প্রাণের পাকে পাকে
বিনম্র পাপবোধ...
লোমকূপে আজ শালুকের তীব্রতা...
চোখের সামনে নিঃশব্দ তরঙ্গমালা নিয়ে
বয়ে চলে নদী...
লেখা হয়ে যায় বৃষ্টিপাতের ক্ষণ... ।
তরঙ্গ ভেঙে ভেঙে ভেসে যাই আমি...
ঝরে পড়ে টুপটাপ আদিম বিভূতি...
পা ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগোতে থাকে
সবুজ কামনা...
আত্ম নিবেদনে বুকের ওঠানামা...
লেপটে থাকা শাড়ীর ভাঁজে
উঠে আসে চাঁদ...
আহত চাঁদের গায়ে সমর্পণের জল...  ।



কাজল দত্ত


দাসুরাম


দাসুরাম ফাসুড়ে বাড়ি তার বেলুড়ে
তাগড়ায় চেহারায় মস্ত সে গোঁফ,
একবার একা একা গিয়েছিল আমেরিকা
তারে নাকি ডেকেছিল অষ্টম পোপ।

গোলগাল দেহটা, ইহা বড় ভুঁড়িটা
কম করে গুনে খায় চার কুঁড়ি পরোটা।
দেখে তারে ভয়ে মরে কোরিয়ার কিম,
ফাসুড়ের তাড়া খেয়ে চীন পাড়ে ডিম।

আজ আর ফাঁসি নাই ফাসুড়ের কাজ নাই,
বেড়াই ঘুরে ঘুরে দেশ হতে দেশান্তরে
অবসরে ঢুকে পড়ে তার খোলা টুইটারে
টুক করে দেখে নেয় দেখে কত ফলোয়ারে।

একবার দাসু রাম সাত মন কাঁচা আম
রেগে গিয়ে খেয়েছিল জল দিয়ে গুলে
বছর খানেক ঘুরেছিল সব কিছু ভুলে,
ফাসুড়ে ছিল না দাসু,নেট তাই বলে।

অনন্ত নস্কর

যে পুলিশরা দলদাস


 
দেখি -বর্গী সেজে উর্দি গায়ে 
মিছেই সেবার ভেক ধরিস্ ,
ভুলে গেছিস্, জাতির সেবায় 
তোদের জন্ম - নাম "পুলিশ"। 

গণতন্ত্রের সৈনিক তোরা 
সভ্যতার অতন্দ্র প্রহরী ,
ন্যায়-নীতি জলাঞ্জলি দিয়ে 
রহিলি ভন্ডের পায়ে পড়ি। 

যে জনতা দেয় রে বেতন 
"স্যার" বলে জানায় কুর্নিশ, 
ধিক্-রে তোদের মানবতা 
তাদের থেকেই ঘুষ নিস্! 

পুলিশ রুলের বাইরে গিয়ে
মাথায় মারিস্ রুলের বাড়ি,
চোরের রক্ষায় ঘামাস্ দেহ
সততারে দিস্ হাতকড়ি ।

চাকরি চাওয়ার কী অপরাধ ?
শিক্ষা চাওয়ায় মিথ্যা কী?
রাজার দোরে বিচার মাগা 
গন্ধ খুঁজিস্ -জানাই ছি!!! 

টুপিতে যার অশোক নিশান 
জাতির সেবায় শপথ যার, 
নৈতিকতার বিচার বসলে 
হবি-ই দোষী দন্ডে তার ।

নিজ ঔরসের নিষ্পাপ শিশু 
পায়না ছোঁয়া পাপের হাত ,
তারা যদি বলে - " দলদাস "
মান রবে কি - পুলিশ জাত???


দুর্গা শংকর বন্দ্যোপাধ্যায়

এখন জ্যৈষ্ঠ মাস


পড়ন্ত বিকেলে
আউটরাম ঘাটে সেদিন
হেমন্তের হ্যাংলা বাতাসটা উড়িয়েছিল
আমার কাঁচাপাকা চুল,
ভার্সিটি পালানো ইরা, দুলেছিল তোমার দুল।
সন্দেহ ভরা ছিল তোমার অবিশ্বাসী চোখ,
দেখতে চাইছিলে আতিপাতি
আমার লড়াকু অভিজ্ঞতা, সে ছিল কঠিন পরখ।
কুঞ্চিত চোখের চামড়া-
আমার কপালে বলিরেখার ভাঁজে ভাঁজে
উদ্ধত অতীতে মুর্খামির খোদাইগুলো দেখছিলে আগ্রহ ভরে,
তোমার মনের আস্থা বাড়াতে।
মাপকাঠি নাম্বার টু।
শার্টের তিনটে বোতাম খুলে উন্নত
ছাতির অজস্র রোমকূপে
তোমার তেইশী হাতের পরশ দিয়ে
পরীক্ষা করেছিলে
পিয়াসী হৃদয়ের কামনা, তিন নম্বর পরীক্ষা।
দুই ঠোঁটের ক্ষণ সঞ্চালনায় অজান্তেই শুনিয়েছিলে বাণী,
সহমর্মিতার, ভালোবাসার।
আর যুদ্ধ নয়, এসো, আমি শান্তিকামী।
ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে উড়ে আসা পাখিটা বসলো এসে আকাশমনির ডালে,
ওটা বউ কথা কও।
ঝোপের ভিতর কোন বেওড়া শিস দিয়ে শুনিয়েছিল,
"হৃদমাঝারে রাইখবো, ছেড়ে দেবো না"
শিহরণ জাগানি খসখস শব্দ, ওরা একা নয়, সরীসৃপ জড়াজড়ি, সঙ্গিনী বেপথু।
শিস শুনে হঠাৎ তোমার চোখে জমলো বাদুলে মেঘ,
হুশ করে জল দাপিয়ে ভাগীরথীর বুকে,  
ছুটে গেল মোটরবোট, বাড়িয়ে বেগ।
একী, ধরলে হাত, থামলে না,
এখন জ্যৈষ্ঠ মাস, কাঁঠালের আঠা-
ছাড়লো না।