Tuesday, November 1

দোলা ভট্টাচার্য্য

 
ভুত শিকারী আমি 



ভুত শিকারী! তা লোকে আমায় বলে বটে। ওহো। তোমরা আবার "মেজকর্তা" র সাথে গুলিয়ে ফেলো না আমাকে। হ্যাঁ হ্যাঁ। "ভুত শিকারী মেজকর্তা" নামে সবাই তাঁকে চেনে। বিখ্যাত সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র মহাশয় তাঁর সাথে পরিচয় করিয়েছিলেন। তারপর থেকেই "মেজকর্তা" আমার বড় প্রিয়। আমার ভুত শিকারের বাতিকটা বলতে পারো তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া। শ্মশানে, পোড়োবাড়িতে, হাসপাতালের মর্গে, কোথায় না কোথায় খুঁজে বেড়িয়েছি তেনাদের । কখনো  দেখা পেয়েছি, কখনো বা কিছু টেরই পাইনি। মেজকর্তার মতো আমারও একটা খেরোর খাতা আছে। তাতে আমি ভুত শিকারের নানা কাহিনী লিপিবদ্ধ করে রাখি। সেইসব অভিজ্ঞতার কথা কিছু কিছু ছাপাও হয়েছে বটে। এবারেও একটা ভুতের গল্প লেখার বরাত পেয়েছি, সন্ধ্যাতারা পত্রিকার পুজো সংখ্যায়। সময় আর বেশি নেই। এদিকে বাড়িতে বিয়ে লেগেছে। ভাইঝির বিয়ে। সারাদিন এ আসছে, ও যাচ্ছে। ক্যাঁচোর ম্যাচোর লেগেই আছে। একটু নিরিবিলি তে বসে লিখব, তার উপায় নেই। আমার ঘরটাই হয়েছে সবার আড্ডাখানা। বন্ধু মৃগাঙ্ক অবশেষে সমস্যার সমাধান করে দিল। "আমাদের গ্রামের বাড়ি রায় ভিলায় চলে যা। বিশাল ফাঁকা বাড়ি, বাগান, পুকুর, মাঠ, বিশুদ্ধ হাওয়া, পুকুরের টাটকা মাছ, হৃষ্টপুষ্ট মুরগি কোনটারই অভাব হবে না।  ননী ঠাকুমার হাতের রান্না, পাত চেটে খাবি, আর মনের সুখে লিখবি। চলে যা।" প্রস্তাব টা মনে ধরল। পরদিনই তল্পিতল্পা গুটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রায় ভিলার উদ্দেশ্যে ।শান্তিপুর স্টেশন থেকে বাসে করে সোনাইদিঘী। সেখান থেকে হেঁটে আরও কয়েক কিলোমিটার পাড়ি দিতে হল। সোনাইদিঘী বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল রায় ভিলার কেয়ারটেকার ঘনশ্যাম বসু ওরফে শ্যাম কাকা। গতকালই ফোন করে আমার আসার কথা ওনাকে জানিয়েছে মৃগাঙ্ক।




রায়ভিলার বিশাল সিং দরজার  সামনে এসে যখন দাঁড়ালাম, ঘড়িতে তখন সোওয়া তিনটে। দুপুর ঢলে পড়েছে । বিশাল কাঠের পাল্লা ঠেলতেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেল। ঢুকে পড়লাম ভেতরে।
অনেকটা বাগান পার হয়ে মূল বাড়িতে প্রবেশ করার আগে বাইরেটা একটু ভালো করে দেখে নিলাম। বিশাল জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনতলা বাড়িটা । এককালে ভালোই ঠাটবাট ছিল এ বাড়ির। হবেই তো। রাজবাড়ি যে। এখন অবশ্য অনেকটা অংশে ভাঙন ধরেছে।
পায়ে পায়ে অনেকগুলো ঘর পেরিয়ে একটা ঘরে এনে তুলল আমাকে শ্যামকাকা। বুঝলাম, এটাই আমার আগামী কয়েক দিনের আবাসস্থল। মন্দ নয়। বেশ বড় আকারের ঘর। লেখার জন্য টেবিল চেয়ার, শোবার জন্য আরামদায়ক বিছানা, একটা দেয়াল আলমারি, একটা ড্রেসিংটেবিল। ব্যাস ব্যাস। আর কি চাই। ঘরের জানালা দিয়ে বাইরের অনেকটা অংশ দেখা যাচ্ছে। খোলা আকাশের নিচে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। চোখ জুড়ানো দৃশ্য। কলকাতায় তো এমন দৃশ্য বিরল।
ঘরের পাশেই বাথরুম টা অনেকক্ষণ থেকেই টানছিল বেশ। শ্যামকাকা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে বাথরুমে ঢুকলাম। বাঃ! সুন্দর ব্যবস্থা। গীজার রয়েছে দেখছি। গরম জলে বেশ করে স্নান করে নিলাম ।পোষাক পাল্টে বাইরে আসতেই দেখি খাবার রেডি। গরম গরম লুচি, সাদা আলুর তরকারি আর দুটো বড় সাইজের রাজভোগ। এতক্ষণে টের পেলাম, জব্বর খিদে পেয়েছে।
ডান হাতের কাজ সারা হল। জানলার ধারে টেবিলটা টেনে নিয়ে এবার লিখতে বসলাম। লিখতে লিখতে গল্প টা প্রায় শেষের পথে। আবার দরজায় টোকা। ঘড়িতে দেখি রাত দশটা বাজছে। ওরে বাবা! এতক্ষণ ধরে লিখছি! দরজা খুলতেই দেখি শ্যামকাকা। পেছনে একজন খাবারের থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। টেবিলটা ফাঁকা করে দিতে খাবারের থালাটা রেখে চলে গেল সে। শ্যামকাকা বললেন, ঠান্ডা কোরো না।  খেয়ে নিও তাড়াতাড়ি ।শ্যামকাকা চলে যেতে মুখ হাত ধুয়ে খেতে বসে গেলাম। সরু চালের ভাত, মুগের ডাল, আলু-ভাজা, বাঁধাকপির তরকারি আর চিকেন। এই বুঝি ননী ঠাকুমার হাতের রান্না! সত্যি অসাধারণ। কাল একবার গিয়ে ওনার সাথে আলাপ করতে হবে।



খাওয়ার পর ভাবলাম, শুয়েই পড়ি এবার। লেখা তো প্রায় শেষের পথে। কাল সকাল সকাল উঠে শেষ করে ফেলব। তারপর ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়ব এখান থেকে। বিকেলের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যাব।
পোষাক বদলে রাতের পোষাক পরে নিলাম। ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় উঠতে গিয়ে মনে পড়ল, শ্যামকাকা বলেছিল, ওই দেওয়াল আলমারির মধ্যে বালিশ, চাদর, মশারি সব রাখা আছে। শোবার আগে বের করে নিও। অন্ধকারের মধ্যেও একটা আবছা আলোয় ঘরটা ভরে আছে দেখতে পেলাম। ঘরের সব কিছুই দেখা যাচ্ছে। তবে আলোটা কোথা থেকে আসছে বুঝতে পারলাম না। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম দেওয়াল আলমারির দিকে। আলমারির পাল্লা খুলতেই হতবাক আমি। এ কী! এ তো আলমারি নয়। এটা তো একটা দরজা। ওপাশে একটা মস্ত বড় সুসজ্জিত ঘর রয়েছে। ঘরের মাঝখানে আরাম কেদারায় বসে রয়েছেন এক বৃদ্ধ মানুষ। আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন তিনি। কি করব ভাবছি। এমন সময় জলদ গম্ভীর স্বরে তিনি বলে উঠলেন, "ওহে ছোকরা! আজ বিকেলে তুমিই এখানে এসেছো?"
বিনম্র ভাবে উত্তর দিলাম, "হ্যাঁ। আমিই।"
"তা, মতলবটা কি বলো দেখি! গল্প টল্প লেখো নাকী"?
মাথা  চুলকে উত্তর দিলাম, "ওই আর কি"।
"তা কিসের গল্প লেখো হে ছোকরা ? ভুতের নাকী?"
সলজ্জ ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়লাম। 
"বেশ বেশ।"
আমার খুব কৌতুহল হচ্ছে, কে এই মানুষটি? শুনেছিলাম তো এই বাড়িতে কেউই থাকে না। সরিকরা সবাই রাজ্যের বাইরে থাকেন । কেউ কেউ দেশের বাইরেও রয়েছেন। তাহলে ইনি এলেন কোথা থেকে। অবাক হয়ে দেখি, আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন বৃদ্ধ। "কি! ধন্দে পড়ে গেলে তো আমার পরিচয় নিয়ে! আমি হলাম তোমার বন্ধু মৃগাঙ্কর কাকাদাদু, মানে ওর বাবার কাকা।"
তাড়াতাড়ি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম, "ও, আচ্ছা ।তা কেমন আছেন কাকাদাদু! শরীর টরীর ভালো তো"?
"ওই চলে যাচ্ছে একরকম। সুখে দুঃখে অনেক গুলো বছর কেটে গেল । সুখের থেকে দুঃখ পেলাম বেশি। তবু এই বাড়ির মায়া কাটাতে পারলাম কই ! " বৃদ্ধের মুখে বিষণ্ণতার ছায়া ঘনিয়েছে দেখে বললাম, "সুখ দুঃখ এই নিয়েই তো আমাদের সংসার কাকাদাদু। এ নিয়ে দুঃখ করবেন না।"
" দুঃখের কথা আর কি বলব তোমায়! একটা সময়ে এই বাড়ি গমগম করত। তারপর কি যে হল! একে একে সবাই চলে গেল। একমাত্র মেয়েটা ছিল আমার। তা সে ও একদিন পুকুরে ডুবে মরল। ওর দেহটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।"
বৃদ্ধের জলমগ্ন চোখদুটো দেখতে দেখতে বললাম," সে কী "!
" পরে অবশ্য আমিই ওকে খুঁজে পেয়েছিলাম ।এই পুকুরের মধ্যে খুব গভীর একটা কুপ আছে। সেই কুপের মধ্যে আড়াআড়ি ভাবে আটকে ছিল ও। "
" তারপর "?
" তারপর আর কি"!
" আপনি ওই কুয়োর মধ্যে নেমেছিলেন "?
" হ্যাঁ ।আসলে আর পাঁচজনের থেকে আমার শরীরটা একটু আলাদা ধরনের । খুব হালকা পলকা। যখন খুশি যেখানে খুশি যেতে পারি। আগে অবশ্য এমন ছিলাম না। রোগে রোগে জর্জরিত দেহ ছিল আমার। একদিন ঘরের একটা কড়িকাঠ ভেঙে পড়ল মাথার ওপর। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। জ্ঞান ফিরতে দেখি, আমার শরীরটা একদম হালকা হয়ে গেছে। কোনোরকম অসুস্থতার চিহ্ন নেই। তার পর থেকে ভালোই আছি। কিন্তু ভালো থাকলে কি হবে। জীবনের সুখগুলো যে হারিয়ে গেছে। কেউ আর কাছে আসে না। একা থাকার দুঃখ অসহনীয়। তারপর একদিন খুঁজে পেলাম মেয়েটাকে। আদর করে তুলে আনলাম ওকে। অনেক দুঃখ নিয়ে মরতে গিয়েছিল ও।"
মাথা ঘুরছে আমার। কি শুনছি এসব! তবু জিজ্ঞেস করলাম," তারপর "!
" তারপর আর কি। বাপ বেটি মিলে সুখেই আছি। ও কাউকে বিশেষ দেখা দেয় না। আড়ালে থাকতেই ভালোবাসে। আমি অবশ্য একটু আধটু বেরোই। মাঝে মাঝে দেহটা প্রকট হতে চায়। তখন একটু ঝামেলা বাধে বৈকি। দু একজন দেখে ফেলে আমাকে। ভয় ও পায়। দাঁত কপাটি লাগে। আমি কি করব তাতে! আমি তো ইচ্ছে করে কারও ক্ষতি করতে চাইনি। তবে তোমার দেখছি সাহস আছে। এত কিছু শুনেও বিন্দাস রয়েছো "।
বিন্দাস নেই আমি। কি করে বোঝাই!
" ওমা, কোথায় গেলি! ছেলেটা এসেছে কতক্ষণ আগে। ওকে একটু মিষ্টিমুখ করাবি না! "সহসা দেখি পর্দার আড়াল থেকে মিষ্টির প্লেট ধরা একটা অস্থিময় হাত বেরিয়ে আসছে। হাতটা লম্বা হতে হতে আমার সামনে এসে থেমে গেল। খোঁনা গলায় হাতের কর্তৃ বললেন, "নিঁন, এঁকটুঁ মিঁষ্টিঁমুঁখ কঁরুঁন "।
হে ভগবান! এই মিষ্টি খেলে তো আমার পঞ্চত্ব প্রাপ্তি অনিবার্য। হাত জোড় করে বললাম, "না না, মিষ্টিমুখ অন্যদিন হবে না হয়। আজ বরং আসি।" বলতে বলতে দরজার দিকে ছুট লাগালাম। শুনতে পেলাম, পেছন থেকে মিলিত স্বরে কারা যেন বলছে, "আমাদের কথা লিখ কিন্তু। আমাদের সুখগুলো হারিয়ে গেছে। আমরা বড় দুঃখে আছি"।

           চোখের ওপর সকালের রোদ পড়তে ঘুমটা ভেঙে গেল ।আর তখনই মনে পড়ল ইনকমপ্লিট গল্পের কথা। তাড়াতাড়ি উঠে টেবিলের কাছে গেলাম। খাতাটা খুলে একবার পড়লাম আমার লেখা টা। পছন্দ হল না। আবার নতুন করে লিখতে হবে। গল্পের প্লট তো আমি পেয়েই গেছি। মুখহাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে বসতে না বসতেই গরম চা এসে হাজির। চা খেয়ে লিখতে বসে গেলাম।
  লেখা শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকালাম। সকাল দশটা। এইবার জলখাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়ব। ভাইঝির বিয়েটা নিশ্চিন্তে উপভোগ করতে পারব।

No comments:

Post a Comment

লেখা পড়ুন এবং মতামত জানান ।